(পার্থ সারথি দাস, কালের কণ্ঠ) গায়ে ঘিয়ে রঙা পাঞ্জাবি। চোখে চশমা। মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। মাথায় সাদাকালো পরিপাটি চুল। দিনভর বক্তব্য দিতে দিতে ক্লান্ত। দিনের অনুষ্ঠান শেষ করে সন্ধ্যায় ফিরেছেন হোটেলে। ক্লান্ত, তবে এর ছাপ নেই চোখেমুখে। ক্লান্তি চাপা পড়েছে মুখভরা হাসিতে। দাঁড়ানোর মতো সময় তাঁর নেই। একটু পরেই আরেক জায়গায় যাওয়ার আমন্ত্রণ রয়েছে। সকালে (গতকাল সোমবার) বিমানে চেপে দেশে ফেরার কথা।
লবিতে কিছু মুহূর্ত বসে ছিলেন। ঢাকায় আসার পর মুহূর্তগুলো যেন খুব দ্রুত পার হচ্ছে। ওপরতলায় গিয়ে তৈরি হতে হবে পরবর্তী আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার জন্য। সে তাড়ায় লিফটে উঠলেন। এতক্ষণ লবিতেই কথা হচ্ছিল। লিফটে তিনি বললেন, বাংলাদেশে শিশু পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। স্কুলগামী শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। বিপুলসংখ্যক মেয়েশিশু স্কুলে যাচ্ছে। একটু থেমে বললেন, শিশুদের জন্য বনু্লসুলভ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আরো কর্মসূচি দরকার।
২০১৪ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী শিশু অধিকার আন্দোলনের নিবেদিত সংগঠক কৈলাস সত্যার্থী রবিবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠ'র সঙ্গে একান্তে কথা বলেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে। ত্রিশ বছর আগে শিশু অধিকার রক্ষার আন্দোলন শুরু করেন মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী কৈলাস সত্যার্থী। ৬১ বছর বয়সী কৈলাস ভারতে 'বাচপন বাঁচাও আন্দোলন' নামের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৩ সালে এটি গড়ে তোলেন তিনি। নিজ শহর বিদিশা ছাড়াও ওড়িশা ও মধ্য প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দিলি্ল, মুম্বাইয়ের মতো নগরীতে শিশুপাচার, শিশুশ্রম, শিশু-নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। 'গ্লোবাল মার্চ অ্যাগেইনস্ট চাইল্ড লেবার' নামের সংস্থাটিও তিনি গড়েছেন।
রবিবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে গ্লোবাল মার্চের সহযোগিতায় বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন কৈলাস সত্যার্থী। ২৯ মে ঢাকায় আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুষ্ঠানে, চারজন মন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক এবং মানবাধিকার-সংক্রান্ত একাধিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। রবিবার নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তিনি।
২০১০ সালে শিশু অধিকারের জন্য লংমার্চ কর্মসূচিতে অংশ নিতে সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন কৈলাস। আগেও শিশু অধিকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে তিনি এ দেশে এসেছেন।
বাংলাদেশে শিশু পরিস্থিতির বিষয়ে কী পরিবর্তন লক্ষ করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে কৈলাস সত্যার্থী বলেন, অবশ্যই পরিবর্তন হয়েছে। স্কুলগামী শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, শিশুমৃত্যুর হার কমে যাওয়ার বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করেন তিনি। যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর পরও কিছু ক্ষেত্রে শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি। কৃষিকাজেও শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। তারা পাচারের শিকার হচ্ছে। রাস্তায় শিশু ভিক্ষুকদের দেখা যায়। দোকানেও শিশুরা শ্রম বিক্রি করছে।
১৯৯১ সালে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। দুই দশক পরও পৌনে এক কোটি শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। এ অবস্থার পরিবর্তনে কী করা উচিত জানতে চাইলে কৈলাস সত্যার্থী বলেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। শিক্ষার আলো আরো ছড়াতে হবে। মেয়েশিশুর শিক্ষায় বেশি জোর দিতে হবে।
লবিতে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলেন এই নোবেলজয়ী। একসময় লিফটে উঠে পড়েন। উঠে দেখেন, লিফট চলছে না। একটু বিস্মিত ও বিব্রত কৈলাস কথা থামিয়ে দেন। একটু চেষ্টা করতেই অবশ্য উঠতে শুরু করে লিফট। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার কথা বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে শিশু অধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে হবে। অর্থনীতিও এর সঙ্গে সম্পর্কিত। শিশুশিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হবে।
কৈলাস সত্যার্থী শিশুদের বন্ধু। শিশুদের করুণার চোখে দেখা ঠিক নয় বলে তিনি মনে করেন। শিশু অধিকার রক্ষার আন্দোলনে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। কথায় কথায় জানা গেল, ছয় বছর বয়সে তিনি একদিন দেখতে পান, তাঁর স্কুলের পাশে তাঁর বয়সী একটি শিশু জুতা পরিষ্কারের কাজ করছে। আরো খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তাঁর বয়সী অনেক শিশু স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের কাজ করতে হচ্ছে। শিশুদের অধিকার রক্ষায় কাজ করতে গিয়ে ওই সব কথা মনে পড়ে তাঁর।
'বাচপন বাঁচাও আন্দোলন' ও 'গ্লোবাল মার্চ'-এর কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন কৈলাস সত্যার্থী। উভয় সংস্থার উদ্যোগে গত ৩০ মার্চ নয়াদিলি্লতে এক সংলাপ অনুষ্ঠানে তিনি শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে শিশুপাচার ও শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে পরিশ্রম করতে হবে সবাইকে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ