চ ঞ্চ ল আ শ রা ফ
পৃথিবীতে খুব কম লেখকই আছেন, যারা চর্চা করেছেন চেতনা কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির। হুমায়ুন আজাদ তাদের একজন । বাঙলা ভাষায় এ-রকম লেখক অঙুলিমেয়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যতো লেখক আবিভর্ূত ও বিকশিত হয়েছেন, গণ্য হয়েছেন শ্রেষ্ঠ বলে, তাদের মধ্যে চেতনা কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা দেখা গেছে খুব কম, গেলেও তা জোরালো নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরোক্ষ, হয়তো খুব নিরীহ; বিপুল অধিকাংশেরই দৃষ্টিভঙ্গি বলে কিছু নেই। আছে অগণন গ্রন্থ, সেগুলোয় জীবন নিয়ে সাহিত্য করার একটা অভিপ্রায় বা খেয়াল পাওয়া যায়; একটা বড় পাঠকশ্রেণীকে আচ্ছন্ন ও খুশি করার লক্ষ্য টের পাওয়া যায়; কিন্তু জীবন সম্পর্কে লেখকের অভিব্যক্তিটি কী, তা খুঁজে বের করার কোনও সুযোগ ওগুলোয় নেই। বাঙলা সাহিত্যে যে-জীবন, তা আবেগ ও ভাবালুতাময়; যে-মানুষ দেখা যায় তাতে, সে মানসিকভাবে অবিকশিত, নির্বোধ, কাতর; কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা আছে এবং তা অপরিণত মানুষের আকাঙ্ক্ষা; বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি জৈবিক ও বুদ্ধিহীন। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলে এক বিশেষ ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে বাঙলা ভাষায় এবং কেউ কেউ এই কাজে বিখ্যাত হয়েছেন। সেগুলোয় হত্যা, অগি্নকাণ্ড, ধ্বংস, ধর্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদির বিবরণ খুব আছে; মুক্তিযোদ্ধাও আছেন; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নেই। এ-ধরনের উপন্যাসে বা গল্পে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে যাওয়ার মুহূর্ত থেকেই শারীরিক বা মানসিকভাবে পঙ্গু; শুরু থেকেই কাপুরুষের জীবন তারা যাপন করছে। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলো পড়লে মনে হয়, এই বাঙলায় বীর নেই, তার দরকারও নেই; কাপুরুষরাই এদেশকে স্বাধীন করেছে। এ-ই হচ্ছে বাঙালি লেখকদের মুক্তিযুদ্ধবোধ, যা থেকে রাশি রাশি কথাসাহিত্যের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন ঘটেছে।
হুমায়ুন আজাদকে পৃথক করা যায় এই বিপুল অপদার্থ সাহিত্যের মধ্য থেকে। যেমন করা যায় আলবেয়ার কামু্যকে; জা পল সার্ত্রকে; সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহকে; গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে। তাঁদের চেতনা বা দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রে এই পৃথকত্ব সঞ্চারিত হয়েছে। সার্ত্র যেমন সাহিত্যে প্রকাশ করে গেছেন তার দর্শন, হুমায়ুন আজাদের সাহিত্যে তার সংবেদনশীলতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অভিব্যক্ত হয়েছে। সেটি নতুন কিছু নয়, হওয়া জরুরিও নয়। তবে বাঙলা সাহিত্যে এই চেতনা অনতুনও নয়। চেতনাটি কী? এটি বস্তুত সর্বব্যাপী অমঙ্গলবোধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর আধুনিক সাহিত্যে যার প্রকাশ ঘটে ইউরোপীয় লেখক-শিল্পীদের হাতে। ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য (২০০৪) গ্রন্থের 'আমরা যেভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছি' গল্পটি পড়লে তা সামগ্রিকভাবে বুঝতে পারা যায়। হুমায়ুন আজাদের সব রচনায় তা কম-বেশি বোঝা যায়; তবে গল্পটি হতে পারে তার সংবেদনশীলতা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। কারও কারও কাছে একে গল্প মনে না-ও হতে পারে। কেননা, এটি আত্মসমর্পণ করেছে চেতনার কাছে; চেতনাই হয়ে উঠেছে এই গল্পের প্রভু; ফলে বিপর্যস্ত হয়েছে এর আঙ্গিক। এইসব বিতর্ক চলতে পারে অন্যত্র; কিন্তু পৃথিবী, প্রকৃতি, আমাদের এই দেশ আর জাতি সম্পর্কে যে অভিব্যক্তি এতে প্রকাশ পেয়েছে, তা জানিয়ে দেয়, খুব ভালো করে জানিয়ে দেয় হুমায়ুন আজাদের চেতনাটি কী, চিনিয়ে দেয় তিনি কোন গ্রহের বাসিন্দা; বুঝিয়ে দেয় সে গ্রহটির বাস্তবতা ও পরিণতি সংবেদনশীল কোনও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে কি-না।
গল্পটির শুরুতেই তিনি যে-অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন, তাতে স্পষ্ট যে, ধ্বংস হতে থাকা এই পৃথিবী আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া; প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের বিলুপ্তির শঙ্কাটিও সেভাবেই আমাদের অনুভূতিতে প্রবেশ করেছে এবং চারপাশের ঘটনারাশি একে বদ্ধমূল করে ফেলেছে। আমাদের জড়জগতের বহু কিছু"নদী, জমি, আকাশ, মেঘ"আর আগের মতো নেই। প্রজাপতি, ইঁদুর, কুমির, রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী, কেরানি, বুদ্ধিজীবী, নারী, জীবজগতের এইসব 'প্রজাতি' টিকে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত। তারা আগের মতো নেই, টিকে থাকার চেষ্টায় তাদের বৈশিষ্ট্য ও চেহারা পাল্টে গেছে। গল্পটিতে বারবার বলা হয়েছে, 'প্রাণ ধ্বংস হতে চায় না', 'টিকে থাকার জন্যে তার আছে বিপুল শক্তি'; 'প্রাণ অপ্রতিরোধ্য' 'অমর, টিকে থাকার পথের তার অভাব নেই।' অর্থাৎ প্রাণ থাকবে, কিন্তু তা নিজের আসল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে; ধ্বংসকালীন প্রতিবেশে খাপ খাওয়ানোর লড়াই তাদের জন্যে অবধারিত। এই প্রাণের জীবন বলে কিছু নেই; আছে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় নিজেকে বদলে ফেলার অবিরাম সাধনা। কিন্তু এই চেষ্টা আর টিকে থাকায় আমরা কেবল অভ্যস্ত; এটা আমাদের সুখিও করে।
'ঃদেখি আমাদের ধানগাছে ধান হয়েছে গাবের দানার মতো, তাতে গুচ্ছ গুচ্ছ কাঁটাও আছে।
আমরা ভয় পাই, কিন্তু সুখী হই।
কয়েক দিন আগে ঘরে ফিরে আমার প্রিয় বেড়ালকে দেখতে পাই না; দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি হায়েনা।ঃ
দেখি সেটি আমার দিকে তাকিয়ে আগের মতো মিউ মিউ ডাকার চেষ্টা করছে।
মিউ সে ডাকতে পারে না, ওর কণ্ঠ থেকে 'হা হা হা হা' শব্দ উঠতে থাকে।
আমি বলি, বেড়াল, তুমি টিকে আছো?
বেড়াল হা হা হা হা করে ওঠে। আমি সুখী হই।
আমাদের দেশ জুড়ে দিকে দিকে এখন টিকে থাকার উৎসব চলছে।'
প্রতিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া, এর মধ্য দিয়ে প্রাণিজগতের টিকে থাকা এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রাণীর বৈশিষ্ট্যবদল, এসবকে উপজীব্য করা থেকে বেশ বোঝা যায়, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে তিনি গল্পে কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু এতেই গল্পটির আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। তত্ত্বের স্তর পেরিয়ে এটি হয়ে উঠেছে রূপক; প্রকৃতির বিলোপ ও মানুষের সর্বব্যাপী পতনের রূপক। তা কেবল সমকালীন বাস্তবতাকে ধারণ করছে না, অতিক্রমও করছে; অধিকন্তু ভবিষ্যৎ-বাস্তবতার বিজ্ঞানসম্মত পূর্বাভাস দিচ্ছে এবং তাকে প্রামাণ্য করেও তুলছে।
গল্পটির সূত্রে আমাদের ভূখণ্ডের জীবনের যে-চিত্র বা ব্যাখ্যা হাজির করেছেন হুমায়ুন আজাদ, তাতে তাঁর প্রবল নৈরাশ্যচেতনা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। এই চেতনা শূন্যে নয়, এর একটা ভিত্তি আছে। এটি হঠাৎ পাওয়া কোনও বস্তু নয়, এর একটা প্রেক্ষাপট, ইতিহাস ও ধারাবাহিকতা রয়েছে। যে-পতন দেখানো হয়েছে তা সার্বিক, বিচ্ছিন্নভাবে এটি ঘটে না; প্রকৃতির জড়বস্তুতে এর সূচনা; কালে কালে তা গ্রাস করে জীবজগৎকে। বিজ্ঞান তার পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যার ভিত্তি। হুমায়ুন আজাদের এই গল্পের ভিত্তি বিজ্ঞান, বিষয় সমকালীন বাস্তবতা; যাতে তিনি দেখিয়েছেন বাঙালির সর্বব্যাপী পতন ও টিকে থাকার চিত্র; কিন্তু এতেই নিঃশেষিত নয় এর মর্ম। কেননা, শেষ পর্যন্ত গল্পটি প্রকৃতি ও মানুষের পতন ও টিকে থাকার রূপক। যদিও আর সব রূপকের মতো এটি কাহিনিনির্ভর নয়। জীবন, স্বদেশ ও পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা ও মনোভাব, তারও রূপক এই গল্প। এই ধারণা আর মনোভাব প্রকাশের সাধনা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদ করে গেছেন এবং এতেই সূচিত হয়েছে আর সব বাঙালি লেখক থেকে তাঁর পৃথকত্ব। (সূত্র: ইত্তেফাক)
পৃথিবীতে খুব কম লেখকই আছেন, যারা চর্চা করেছেন চেতনা কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির। হুমায়ুন আজাদ তাদের একজন । বাঙলা ভাষায় এ-রকম লেখক অঙুলিমেয়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যতো লেখক আবিভর্ূত ও বিকশিত হয়েছেন, গণ্য হয়েছেন শ্রেষ্ঠ বলে, তাদের মধ্যে চেতনা কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা দেখা গেছে খুব কম, গেলেও তা জোরালো নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরোক্ষ, হয়তো খুব নিরীহ; বিপুল অধিকাংশেরই দৃষ্টিভঙ্গি বলে কিছু নেই। আছে অগণন গ্রন্থ, সেগুলোয় জীবন নিয়ে সাহিত্য করার একটা অভিপ্রায় বা খেয়াল পাওয়া যায়; একটা বড় পাঠকশ্রেণীকে আচ্ছন্ন ও খুশি করার লক্ষ্য টের পাওয়া যায়; কিন্তু জীবন সম্পর্কে লেখকের অভিব্যক্তিটি কী, তা খুঁজে বের করার কোনও সুযোগ ওগুলোয় নেই। বাঙলা সাহিত্যে যে-জীবন, তা আবেগ ও ভাবালুতাময়; যে-মানুষ দেখা যায় তাতে, সে মানসিকভাবে অবিকশিত, নির্বোধ, কাতর; কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা আছে এবং তা অপরিণত মানুষের আকাঙ্ক্ষা; বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি জৈবিক ও বুদ্ধিহীন। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলে এক বিশেষ ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে বাঙলা ভাষায় এবং কেউ কেউ এই কাজে বিখ্যাত হয়েছেন। সেগুলোয় হত্যা, অগি্নকাণ্ড, ধ্বংস, ধর্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদির বিবরণ খুব আছে; মুক্তিযোদ্ধাও আছেন; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নেই। এ-ধরনের উপন্যাসে বা গল্পে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে যাওয়ার মুহূর্ত থেকেই শারীরিক বা মানসিকভাবে পঙ্গু; শুরু থেকেই কাপুরুষের জীবন তারা যাপন করছে। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলো পড়লে মনে হয়, এই বাঙলায় বীর নেই, তার দরকারও নেই; কাপুরুষরাই এদেশকে স্বাধীন করেছে। এ-ই হচ্ছে বাঙালি লেখকদের মুক্তিযুদ্ধবোধ, যা থেকে রাশি রাশি কথাসাহিত্যের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন ঘটেছে।
হুমায়ুন আজাদকে পৃথক করা যায় এই বিপুল অপদার্থ সাহিত্যের মধ্য থেকে। যেমন করা যায় আলবেয়ার কামু্যকে; জা পল সার্ত্রকে; সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহকে; গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে। তাঁদের চেতনা বা দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রে এই পৃথকত্ব সঞ্চারিত হয়েছে। সার্ত্র যেমন সাহিত্যে প্রকাশ করে গেছেন তার দর্শন, হুমায়ুন আজাদের সাহিত্যে তার সংবেদনশীলতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অভিব্যক্ত হয়েছে। সেটি নতুন কিছু নয়, হওয়া জরুরিও নয়। তবে বাঙলা সাহিত্যে এই চেতনা অনতুনও নয়। চেতনাটি কী? এটি বস্তুত সর্বব্যাপী অমঙ্গলবোধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর আধুনিক সাহিত্যে যার প্রকাশ ঘটে ইউরোপীয় লেখক-শিল্পীদের হাতে। ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য (২০০৪) গ্রন্থের 'আমরা যেভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছি' গল্পটি পড়লে তা সামগ্রিকভাবে বুঝতে পারা যায়। হুমায়ুন আজাদের সব রচনায় তা কম-বেশি বোঝা যায়; তবে গল্পটি হতে পারে তার সংবেদনশীলতা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। কারও কারও কাছে একে গল্প মনে না-ও হতে পারে। কেননা, এটি আত্মসমর্পণ করেছে চেতনার কাছে; চেতনাই হয়ে উঠেছে এই গল্পের প্রভু; ফলে বিপর্যস্ত হয়েছে এর আঙ্গিক। এইসব বিতর্ক চলতে পারে অন্যত্র; কিন্তু পৃথিবী, প্রকৃতি, আমাদের এই দেশ আর জাতি সম্পর্কে যে অভিব্যক্তি এতে প্রকাশ পেয়েছে, তা জানিয়ে দেয়, খুব ভালো করে জানিয়ে দেয় হুমায়ুন আজাদের চেতনাটি কী, চিনিয়ে দেয় তিনি কোন গ্রহের বাসিন্দা; বুঝিয়ে দেয় সে গ্রহটির বাস্তবতা ও পরিণতি সংবেদনশীল কোনও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে কি-না।
গল্পটির শুরুতেই তিনি যে-অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন, তাতে স্পষ্ট যে, ধ্বংস হতে থাকা এই পৃথিবী আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া; প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের বিলুপ্তির শঙ্কাটিও সেভাবেই আমাদের অনুভূতিতে প্রবেশ করেছে এবং চারপাশের ঘটনারাশি একে বদ্ধমূল করে ফেলেছে। আমাদের জড়জগতের বহু কিছু"নদী, জমি, আকাশ, মেঘ"আর আগের মতো নেই। প্রজাপতি, ইঁদুর, কুমির, রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী, কেরানি, বুদ্ধিজীবী, নারী, জীবজগতের এইসব 'প্রজাতি' টিকে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত। তারা আগের মতো নেই, টিকে থাকার চেষ্টায় তাদের বৈশিষ্ট্য ও চেহারা পাল্টে গেছে। গল্পটিতে বারবার বলা হয়েছে, 'প্রাণ ধ্বংস হতে চায় না', 'টিকে থাকার জন্যে তার আছে বিপুল শক্তি'; 'প্রাণ অপ্রতিরোধ্য' 'অমর, টিকে থাকার পথের তার অভাব নেই।' অর্থাৎ প্রাণ থাকবে, কিন্তু তা নিজের আসল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে; ধ্বংসকালীন প্রতিবেশে খাপ খাওয়ানোর লড়াই তাদের জন্যে অবধারিত। এই প্রাণের জীবন বলে কিছু নেই; আছে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় নিজেকে বদলে ফেলার অবিরাম সাধনা। কিন্তু এই চেষ্টা আর টিকে থাকায় আমরা কেবল অভ্যস্ত; এটা আমাদের সুখিও করে।
'ঃদেখি আমাদের ধানগাছে ধান হয়েছে গাবের দানার মতো, তাতে গুচ্ছ গুচ্ছ কাঁটাও আছে।
আমরা ভয় পাই, কিন্তু সুখী হই।
কয়েক দিন আগে ঘরে ফিরে আমার প্রিয় বেড়ালকে দেখতে পাই না; দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি হায়েনা।ঃ
দেখি সেটি আমার দিকে তাকিয়ে আগের মতো মিউ মিউ ডাকার চেষ্টা করছে।
মিউ সে ডাকতে পারে না, ওর কণ্ঠ থেকে 'হা হা হা হা' শব্দ উঠতে থাকে।
আমি বলি, বেড়াল, তুমি টিকে আছো?
বেড়াল হা হা হা হা করে ওঠে। আমি সুখী হই।
আমাদের দেশ জুড়ে দিকে দিকে এখন টিকে থাকার উৎসব চলছে।'
প্রতিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া, এর মধ্য দিয়ে প্রাণিজগতের টিকে থাকা এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রাণীর বৈশিষ্ট্যবদল, এসবকে উপজীব্য করা থেকে বেশ বোঝা যায়, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে তিনি গল্পে কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু এতেই গল্পটির আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। তত্ত্বের স্তর পেরিয়ে এটি হয়ে উঠেছে রূপক; প্রকৃতির বিলোপ ও মানুষের সর্বব্যাপী পতনের রূপক। তা কেবল সমকালীন বাস্তবতাকে ধারণ করছে না, অতিক্রমও করছে; অধিকন্তু ভবিষ্যৎ-বাস্তবতার বিজ্ঞানসম্মত পূর্বাভাস দিচ্ছে এবং তাকে প্রামাণ্য করেও তুলছে।
গল্পটির সূত্রে আমাদের ভূখণ্ডের জীবনের যে-চিত্র বা ব্যাখ্যা হাজির করেছেন হুমায়ুন আজাদ, তাতে তাঁর প্রবল নৈরাশ্যচেতনা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। এই চেতনা শূন্যে নয়, এর একটা ভিত্তি আছে। এটি হঠাৎ পাওয়া কোনও বস্তু নয়, এর একটা প্রেক্ষাপট, ইতিহাস ও ধারাবাহিকতা রয়েছে। যে-পতন দেখানো হয়েছে তা সার্বিক, বিচ্ছিন্নভাবে এটি ঘটে না; প্রকৃতির জড়বস্তুতে এর সূচনা; কালে কালে তা গ্রাস করে জীবজগৎকে। বিজ্ঞান তার পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যার ভিত্তি। হুমায়ুন আজাদের এই গল্পের ভিত্তি বিজ্ঞান, বিষয় সমকালীন বাস্তবতা; যাতে তিনি দেখিয়েছেন বাঙালির সর্বব্যাপী পতন ও টিকে থাকার চিত্র; কিন্তু এতেই নিঃশেষিত নয় এর মর্ম। কেননা, শেষ পর্যন্ত গল্পটি প্রকৃতি ও মানুষের পতন ও টিকে থাকার রূপক। যদিও আর সব রূপকের মতো এটি কাহিনিনির্ভর নয়। জীবন, স্বদেশ ও পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা ও মনোভাব, তারও রূপক এই গল্প। এই ধারণা আর মনোভাব প্রকাশের সাধনা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদ করে গেছেন এবং এতেই সূচিত হয়েছে আর সব বাঙালি লেখক থেকে তাঁর পৃথকত্ব। (সূত্র: ইত্তেফাক)