বাংলাদেশে পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের গুরু আজম খান আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে। রেখে গেছেন তার সংগ্রামী জীবনের অনন্য কীর্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই বীর সেনানীকে হারিয়ে শোকাহত আজ সমগ্র জাতি। আজম খানের গাওয়া জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে রেললাইনের ঐ বস্তিতে, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, আলাল ও দুলাল, এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না, অভিমানী তুমি কোথায় হারিয়ে গেছো, চুপ চুপ চুপ অনামিকা চুপ, আসি আসি বলে তুমি, আমি যারে চাই রে, হাইকোর্টের মাজারে প্রভৃতি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরযোদ্ধা ছিলেন আজম খান। আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে ঢাকা উত্তর অঞ্চলের গেরিলা যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে ঢাকা উত্তরের সেকশন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এক জীবনে আজম খান
আজম খান জন্ম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে। তার আসল নাম মাহবুবুল হক খান । বাবার নাম আফতাবউদ্দিন আহমেদ, মা জোবেদা খাতুন । বাবা সরকারী চাকরি করতেন, পাশাপাশি ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে আজম খান ছিলেন তৃতীয়। আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলের শিশুশ্রেণীতে ১৯৫৫ সালে তার পড়ালেখায় হাতেখড়ি। পরের বছর তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি নির্মাণ করেন। সপরিবারে তারা চলে আসেন কমলাপুর। ১৯৫৬ সালে তিনি ভর্তি হন কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলের প্রাইমারিতে। ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে বাণিজ্য বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেন নি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আজম খান স্বাধীন বাংলাদেশে গান গাওয়াকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৭২ সালে প্রথম কনসার্টে অংশ নেন। ১৯৭৩ সালে গঠন করেন ব্যান্ডদল উচ্চারণ। পপসঙ্গীতে তিনি তৈরি করেন ক্রেজ। ১৯৮১ সালে ৩১ বছর বয়সে আজম খান ঢাকার মাদারটেকে বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সাহেদা বেগম। আজম খানের দুই মেয়ে ইমা খান ও অরনী খান এবং এক ছেলে হৃদয় খান। স্ত্রীর অকাল মৃত্যুর পর আজম খান একাকী জীবনযাপন করছিলেন।
গত বছরের জুলাই মাসে আজম খানের মুখগহ্বরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। সহকর্মী শিল্পীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৪ জুলাই উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে।২০ জুলাই মাউন্ট এলিজাবেথ মেডিকেল সেন্টারে আজম খানের মুখে সফল অস্ত্রোপচার করা হয়। ৭ নভেম্বর দ্বিতীয় দফা রেডিওথেরাপি নিতে সিঙ্গাপুর যান। তাকে মোট ৩০টি টমোথেরাপি (রেডিওথেরাপি) ও ৫টি কেমোথেরাপি দেওয়ার কথা থাকলেও ২১টি টমোথেরাপি (রেডিওথেরাপি) ও ১টি কেমোথেরাপি নেওয়ার পর সুস্থ বোধ করায় তিনি ২৭ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন।
চলতি বছরের ২২ মে প্রচন্ড হাত ব্যথা নিয়ে আজম খান রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৬ মে রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ মে রাতে পপগুরু হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ২৭ মে সকাল থেকে তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। ০১ জুন সকালে স্কয়ার হাসপাতালে তাকে দেখতে যান প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান। রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সেদিনই রাতে আজম খানকে সিএমএইচে নেওয়া হয়। কিন্তু কোনো চেষ্টাই কাজে আসে নি। মৃত্যুর কাছে অবশেষে হার মানতেই হলে কিংবদন্তি শিল্পী আজম খানকে। পরিবার, শিল্পী , শুভানুধ্যায়ী ও অগুনতি ভক্তকে কাঁদিয়ে ৫ জুন সকাল ১০টা ২০ মিনিটে আজম খান চলে গেলেন চিরতরে না ফেরার দেশে।
মুক্তিযুদ্ধের সেকশন কমান্ডার আজম খান
ছোটবেলা থেকেই আজম খান ছিলেন রাজনীতি সচেতন। উপলব্ধি করতেন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শোষণ। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। এ সময় তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে রাজপথে বিপ্লবী গণসঙ্গীত পরিবেশনায় কন্ঠ মেলান। ১৯৭১ সালে বাবা আফতাব উদ্দিন খানের অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দুই বন্ধুর সঙ্গে আজম খান পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে সেক্টর-২ এর আওতায় ভারতের মেলাঘরে ২১ বছর বয়সী আজম খান ট্রেনিং নেন। প্রশিক্ষণ শিবিরে তার গাওয়া গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগাতো।
প্রশিক্ষণ শেষে আজম খান কুমিল্লা অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া শুরু করেন। প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন কুমিল্লার সালদায়। যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তাকে সেকশন কমান্ডার করে ঢাকা ও আশেপাশে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনার জন্য পাঠানো হয়। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি-গুলশান-ডেমরা এলাকার গেরিলা অপারেশানে নের্তৃত্ব দেন।
আজম খান পরিচালিত উল্লেখযোগ্য অপারেশনের মধ্যে ছিল অপারেশন তিতাস ও অপারেশন ইন্টারকন্টিনেন্টাল। তার নেতৃত্বে সরবরাহ পাইপ লাইন ধ্বংশ করে ঢাকার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। আজম খানের নের্তৃত্বেই তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালিয়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। আন্তর্জাতিক এ হোটেলে হামলা চালানোর কারণ ছিল, ঐ হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে দেশে যুদ্ধ চলছে।
এছাড়াও তার নের্তৃত্বে ঢাকার অদূরে মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে ও কালিগঞ্জের সম্মুখ সমরে পাকসেনাদের হটিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। নিজ দলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ২০ নভেম্বর ঢাকায় প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আজম খান।
পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের পথিকৃত আজম খান
সঙ্গীতে আজম খানের হাতেখড়ি ছোটবেলায়। বড়ভাই আজকের সঙ্গীত পরিচালক আলম খান গান শিখতেন। অনেকটা তার দেখাদেখিই গান গাইতে শুরু করেন আজম খান। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর হয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশনায় অংশ নিয়েছেন এই শিল্পী। মুক্তিযুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালে পরিচিত একজন তাকে বিটিভিতে গান পরিবেশনের সূযোগ করে দেন। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেককে ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে তিনি বিটিভির অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ আর ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি প্রচার হয় বিটিভির সেই অনুষ্ঠানে।
নতুনধারার এই গান তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। আজম খান ও তার দল পেয়ে যায় জনপ্রিয়তা। এরপর বন্ধুদের নিয়েই তিনি গড়ে তুললেন উচ্চারণ ব্যান্ড। দল নিয়ে আজম খান স্টেজ পারফর্ম শুরু করেন। তার গায়কী ভঙ্গিমা লুফে নেয় সেই সময়ের তরুণ প্রজন্ম।
১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষাবস্থার সময় একদিন সন্ধায় কমলাপুরের বাসা থেকে রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন আজম খান। হঠাৎ তার চোখে পড়ে ফুটফুটে এক মৃত শিশুকে সামনে রেখে তার মা বিলাপ করছে। বাসায় ফিরে তৈরি করলেন গান ‘রেললাইনের ঐ বস্তিতে জন্মেছিল একটি ছেলে’। গানটি বিটিভিতে প্রচার হওয়ার পর হই চই উঠলো সারাদেশে। নিজে থেকেই ফিরোজ সাঁই তাকে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে এলেন। ফিরোজ সাঁইয়ের মাধ্যমে আজম খান পরিচিত হন ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ আর সদ্য প্রয়াত পিলু মমতাজের সঙ্গে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পপগানের জোয়ার তৈরি হয় সত্তর ও আশির দশকে। বাংলাগানে প্রথম হার্ডরক ধারা যুক্ত করার ক্ষেত্রেও আজম খান অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বন্ধু ইশতিয়াককে নিয়ে তার তৈরি করা ও গাওয়া ‘জীবনে কিছু পাবো না হে’ গানটি এরকমই একটি হার্ডরক গান।
১৯৭৩ সাল থেকে আজম খানের পপ গানের ক্যারিয়ার শুরু। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি উপহার দিয়েছেন অনেক কিছু। গানে গানে মাতিয়েছেন পুরো দেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী তরুণ প্রজন্মকে করেছেন সংগীতমুখী। অগণিত স্টেজ শোর পাশাপাশি তিনি এবং তার ব্যান্ড উচ্চারণ গান করেছে বেশ কিছু অ্যালবামে। তার একক অ্যালবামের সংখ্যা ১৬। দ্বৈত ও মিশ্র অ্যালবাম রয়েছে ২৫ টিরও বেশি। কয়েকটি চলচ্চিত্রেও প্লে-ব্যাক করেছেন তিনি।
অন্যরকম আজম খান
গানের বাইরে পপগুরু আজম খানকে কখনো কখনো দেখা গেছে অন্য ভূমিকায়। কখনো অভিনেতা, কখনো বা মডেল, কখনো আবার ক্রিকেটার হিসেবে। বিটিভির একাধিক নাটকে বাউল চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ নামের একটি ছবিতে নাম ভূমিকায় খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আজম খান। পরবর্তীতে আরো ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলেও তা গ্রহণ করেন নি। এছাড়াও আজম খান মডেল হয়েছেন এনার্জি ড্রিংক আর বাংলালিংকের দুটি বিজ্ঞাপন চিত্রে।
ক্রিকেটার হিসেবে আজম খান তৈরি করে গেছেন এক অনন্য রেকর্ড। তিনি দেশের বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে ৪১ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত একটানা ১০ বছর ক্রিকেট খেলেছেন। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে। ক্রিকেটে আজম খান ছিলেন একজন অল রাউন্ডার। (সূত্র: বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম) লিংক
এক জীবনে আজম খান
আজম খান জন্ম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে। তার আসল নাম মাহবুবুল হক খান । বাবার নাম আফতাবউদ্দিন আহমেদ, মা জোবেদা খাতুন । বাবা সরকারী চাকরি করতেন, পাশাপাশি ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে আজম খান ছিলেন তৃতীয়। আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলের শিশুশ্রেণীতে ১৯৫৫ সালে তার পড়ালেখায় হাতেখড়ি। পরের বছর তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি নির্মাণ করেন। সপরিবারে তারা চলে আসেন কমলাপুর। ১৯৫৬ সালে তিনি ভর্তি হন কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলের প্রাইমারিতে। ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে বাণিজ্য বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেন নি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আজম খান স্বাধীন বাংলাদেশে গান গাওয়াকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৭২ সালে প্রথম কনসার্টে অংশ নেন। ১৯৭৩ সালে গঠন করেন ব্যান্ডদল উচ্চারণ। পপসঙ্গীতে তিনি তৈরি করেন ক্রেজ। ১৯৮১ সালে ৩১ বছর বয়সে আজম খান ঢাকার মাদারটেকে বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সাহেদা বেগম। আজম খানের দুই মেয়ে ইমা খান ও অরনী খান এবং এক ছেলে হৃদয় খান। স্ত্রীর অকাল মৃত্যুর পর আজম খান একাকী জীবনযাপন করছিলেন।
গত বছরের জুলাই মাসে আজম খানের মুখগহ্বরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। সহকর্মী শিল্পীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৪ জুলাই উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে।২০ জুলাই মাউন্ট এলিজাবেথ মেডিকেল সেন্টারে আজম খানের মুখে সফল অস্ত্রোপচার করা হয়। ৭ নভেম্বর দ্বিতীয় দফা রেডিওথেরাপি নিতে সিঙ্গাপুর যান। তাকে মোট ৩০টি টমোথেরাপি (রেডিওথেরাপি) ও ৫টি কেমোথেরাপি দেওয়ার কথা থাকলেও ২১টি টমোথেরাপি (রেডিওথেরাপি) ও ১টি কেমোথেরাপি নেওয়ার পর সুস্থ বোধ করায় তিনি ২৭ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন।
চলতি বছরের ২২ মে প্রচন্ড হাত ব্যথা নিয়ে আজম খান রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৬ মে রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ মে রাতে পপগুরু হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ২৭ মে সকাল থেকে তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। ০১ জুন সকালে স্কয়ার হাসপাতালে তাকে দেখতে যান প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান। রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সেদিনই রাতে আজম খানকে সিএমএইচে নেওয়া হয়। কিন্তু কোনো চেষ্টাই কাজে আসে নি। মৃত্যুর কাছে অবশেষে হার মানতেই হলে কিংবদন্তি শিল্পী আজম খানকে। পরিবার, শিল্পী , শুভানুধ্যায়ী ও অগুনতি ভক্তকে কাঁদিয়ে ৫ জুন সকাল ১০টা ২০ মিনিটে আজম খান চলে গেলেন চিরতরে না ফেরার দেশে।
মুক্তিযুদ্ধের সেকশন কমান্ডার আজম খান
ছোটবেলা থেকেই আজম খান ছিলেন রাজনীতি সচেতন। উপলব্ধি করতেন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শোষণ। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। এ সময় তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে রাজপথে বিপ্লবী গণসঙ্গীত পরিবেশনায় কন্ঠ মেলান। ১৯৭১ সালে বাবা আফতাব উদ্দিন খানের অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দুই বন্ধুর সঙ্গে আজম খান পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে সেক্টর-২ এর আওতায় ভারতের মেলাঘরে ২১ বছর বয়সী আজম খান ট্রেনিং নেন। প্রশিক্ষণ শিবিরে তার গাওয়া গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগাতো।
প্রশিক্ষণ শেষে আজম খান কুমিল্লা অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া শুরু করেন। প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন কুমিল্লার সালদায়। যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তাকে সেকশন কমান্ডার করে ঢাকা ও আশেপাশে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনার জন্য পাঠানো হয়। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি-গুলশান-ডেমরা এলাকার গেরিলা অপারেশানে নের্তৃত্ব দেন।
আজম খান পরিচালিত উল্লেখযোগ্য অপারেশনের মধ্যে ছিল অপারেশন তিতাস ও অপারেশন ইন্টারকন্টিনেন্টাল। তার নেতৃত্বে সরবরাহ পাইপ লাইন ধ্বংশ করে ঢাকার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। আজম খানের নের্তৃত্বেই তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালিয়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। আন্তর্জাতিক এ হোটেলে হামলা চালানোর কারণ ছিল, ঐ হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে দেশে যুদ্ধ চলছে।
এছাড়াও তার নের্তৃত্বে ঢাকার অদূরে মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে ও কালিগঞ্জের সম্মুখ সমরে পাকসেনাদের হটিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। নিজ দলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ২০ নভেম্বর ঢাকায় প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আজম খান।
পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের পথিকৃত আজম খান
সঙ্গীতে আজম খানের হাতেখড়ি ছোটবেলায়। বড়ভাই আজকের সঙ্গীত পরিচালক আলম খান গান শিখতেন। অনেকটা তার দেখাদেখিই গান গাইতে শুরু করেন আজম খান। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর হয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশনায় অংশ নিয়েছেন এই শিল্পী। মুক্তিযুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালে পরিচিত একজন তাকে বিটিভিতে গান পরিবেশনের সূযোগ করে দেন। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেককে ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে তিনি বিটিভির অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ আর ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি প্রচার হয় বিটিভির সেই অনুষ্ঠানে।
নতুনধারার এই গান তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। আজম খান ও তার দল পেয়ে যায় জনপ্রিয়তা। এরপর বন্ধুদের নিয়েই তিনি গড়ে তুললেন উচ্চারণ ব্যান্ড। দল নিয়ে আজম খান স্টেজ পারফর্ম শুরু করেন। তার গায়কী ভঙ্গিমা লুফে নেয় সেই সময়ের তরুণ প্রজন্ম।
১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষাবস্থার সময় একদিন সন্ধায় কমলাপুরের বাসা থেকে রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন আজম খান। হঠাৎ তার চোখে পড়ে ফুটফুটে এক মৃত শিশুকে সামনে রেখে তার মা বিলাপ করছে। বাসায় ফিরে তৈরি করলেন গান ‘রেললাইনের ঐ বস্তিতে জন্মেছিল একটি ছেলে’। গানটি বিটিভিতে প্রচার হওয়ার পর হই চই উঠলো সারাদেশে। নিজে থেকেই ফিরোজ সাঁই তাকে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে এলেন। ফিরোজ সাঁইয়ের মাধ্যমে আজম খান পরিচিত হন ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ আর সদ্য প্রয়াত পিলু মমতাজের সঙ্গে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পপগানের জোয়ার তৈরি হয় সত্তর ও আশির দশকে। বাংলাগানে প্রথম হার্ডরক ধারা যুক্ত করার ক্ষেত্রেও আজম খান অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বন্ধু ইশতিয়াককে নিয়ে তার তৈরি করা ও গাওয়া ‘জীবনে কিছু পাবো না হে’ গানটি এরকমই একটি হার্ডরক গান।
১৯৭৩ সাল থেকে আজম খানের পপ গানের ক্যারিয়ার শুরু। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি উপহার দিয়েছেন অনেক কিছু। গানে গানে মাতিয়েছেন পুরো দেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী তরুণ প্রজন্মকে করেছেন সংগীতমুখী। অগণিত স্টেজ শোর পাশাপাশি তিনি এবং তার ব্যান্ড উচ্চারণ গান করেছে বেশ কিছু অ্যালবামে। তার একক অ্যালবামের সংখ্যা ১৬। দ্বৈত ও মিশ্র অ্যালবাম রয়েছে ২৫ টিরও বেশি। কয়েকটি চলচ্চিত্রেও প্লে-ব্যাক করেছেন তিনি।
অন্যরকম আজম খান
গানের বাইরে পপগুরু আজম খানকে কখনো কখনো দেখা গেছে অন্য ভূমিকায়। কখনো অভিনেতা, কখনো বা মডেল, কখনো আবার ক্রিকেটার হিসেবে। বিটিভির একাধিক নাটকে বাউল চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ নামের একটি ছবিতে নাম ভূমিকায় খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আজম খান। পরবর্তীতে আরো ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলেও তা গ্রহণ করেন নি। এছাড়াও আজম খান মডেল হয়েছেন এনার্জি ড্রিংক আর বাংলালিংকের দুটি বিজ্ঞাপন চিত্রে।
ক্রিকেটার হিসেবে আজম খান তৈরি করে গেছেন এক অনন্য রেকর্ড। তিনি দেশের বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে ৪১ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত একটানা ১০ বছর ক্রিকেট খেলেছেন। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে। ক্রিকেটে আজম খান ছিলেন একজন অল রাউন্ডার। (সূত্র: বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম) লিংক