আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর নিয়ে লাভ না থাকলেও এখন দিন বদলে গেছে। জাহাজ
এখন বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য খাতের একটি সম্ভাবনাময় নাম। কারণ দেশেই
তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের জাহাজ। দেশি প্রযুক্তি ও লোকবল ব্যবহার করে দেশের
শিপইয়ার্ডগুলোতে যাত্রীবাহী জাহাজ,পণ্যবাহী জাহাজ, অয়েল ট্যাংকার, টাগবোট,
ফিশিং বোটসহ নানা ধরনের যান্ত্রিক নৌযান নির্মাণে বাংলাদেশ সফলতা দেখিয়েছে। ‘মেইড
ইন বাংলাদেশ’ লেখা জাহাজ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল শুরু করেছে। এ
দেশের নির্মাণ কাজ বিশ্বমানে উন্নীত হওয়ার পর জার্মানি, ফিনল্যান্ড,
ডেনমার্ক, পাকিস্তান, মোজাম্বিক, লিবিয়া ও মালদ্বীপ এরই মধ্যে মধ্যে
বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জাহাজ নির্মাণে
চুক্তিবদ্ধ ও কার্যাদেশ দিয়েছে। এর পাশাপাশি সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও বিভিন্ন দেশ এ খাতে বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সরকারের
যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা এবং পুঁজি বিনিয়োগকারীরা এ খাতে মনোযোগী হলে আগামীতে
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক খাতে নতুন এক বিপ্লবের সূচনা ঘটবে। প্রতি বছর আয় হবে
বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। এ খাত থেকে কর্মসংস্থান হবে কয়েক লাখ
মানুষের। রিনা নামে ইতালি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভিত্তিক আন্তর্জাতিক
সংস্থা ১৮৬১ সাল থেকে জাহাজ নিয়ে গবেষণা করে করে জাহাজের ক্লাসিফিকেশন করে।
সংস্থাটি জাহাজের মান নির্ধারণ করে সনদ প্রদান করে । এটি বিশ্বব্যাপী
স্বীকৃত মান সংস্থা। সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও
অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের মেরিন ডিভিশনের ম্যানেজার গিওর্গিও সালোত্তি
বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জাহাজের মান নিঃসন্দেহে বর্তমানে
আন্তর্জাতিক মানের। আমি আমার অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন শিপইয়ার্ড পরিদর্শন করে এ
ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি। আর নানা কারণে জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশই হতে পারে
অন্যতম বিকল্প। কারণ বিশ্বের অন্যতম ছোট ও মাঝারি জাহাজ নির্মাণকারী দেশ
চীন, ভিয়েতনাম, ভারতের সব ক`টি শিপইয়ার্ড আগামী ৫ বছরের জন্য বুকড হয়ে আছে।
তাছাড়াও এই দেশগুলো ৩০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার নিচে কোনও জাহাজ
তৈরিতে আগ্রহী নয়। স্বল্প খরচে প্রচুর শ্রমিক পাওয়া ও ছোট জাহাজ নির্মাণের এ
সুযোগ বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারে বলে আমার মনে হয়।’এ সপ্তাহে ছয়টি
জাহাজ নির্মাণে হাত দিয়েছে দেশীয় জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জ
ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড (এনইএসএল)। প্রতিষ্ঠানটির
চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, জাহাজ নির্মাণের মাধ্যমে
বাংলাদেশের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। বিদেশ থেকে জাহাজ আমদানি
করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তার প্রায় অর্ধেক অর্থ ব্যয়ে দেশেই জাহাজ
নির্মাণ সম্ভব। দেশের বিকাশমান এই শিল্প খাতে সহযোগিতার জন্য তিনি সরকার ও গণমাধ্যমের সহায়তা চান। মার্কেন্টাইল
মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমান
বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের দেশে জাহাজ তৈরি শিল্প দেশের উন্নয়নে বড় অবদান
রাখছে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বাংলাদেশ নানা কারণেই অন্যতম ভালো স্থান
হিসেবে গণ্য হচ্ছে।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য
দেশের তুলনায় এখানে জাহাজ নির্মাণের খরচ কম। এ শিল্পে প্রচুর দক্ষ-অদক্ষ
শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণে স্বল্প মজুরিতে প্রচুর
শ্রমিক পাওয়া যায়। আর এ কারণে নির্মাণ খরচ অনেক কম। দক্ষিণাঞ্চল
সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় ভৌগোলিক সুবিধা এ সম্ভাবনার ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক
ভূমিকা পালন করছে।’ বাংলাদেশে সহজলভ্য শ্রম কাজে লাগিয়ে তিনি শিল্পপতিদের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। প্রাইড
নেভিগেশন লি. এর চেয়ারম্যান ডা. এজাজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে
গার্মেন্ট শিল্পের বিপুল বিস্তার ঘটেছে আন্তর্জাতিক বাজারের বিষয়টি মাথায়
রেখেই। আগামীতে জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।‘ অনুসন্ধানে
জানা গেছে, জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা আন্তর্জাতিক নৌ-সংস্থা আইএমও`র জারিকৃত
আইএসপিএস কোডের কারণে ২৫ বছরের বেশি পুরনো জাহাজ আগামী বছর থেকে চলাচল করতে
পারবে না। বাংলাদেশ এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। আইএমও`র এ
নির্দেশনার কারণে কেবল ইউরোপীয় দেশগগুলোকেই কিছুদিনের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার
নতুন জাহাজ বাদ দিতে হবে এবং এর স্থলে নতুন জাহাজ যোগ করতে হবে। আগে থেকেই
অর্ডার থাকার কারণে জাহাজ নির্মাণের জন্য চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান,
ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো আগামী ২০ বছরের জন্য নতুন অর্ডার নিতে
পারছে না। এছাড়া ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলো এখন অত্যাধুনিক যুদ্ধ
জাহাজ সাবমেরিন বানাতে ব্যস্ত। ছোট ও মাঝারি আকারের জাহাজের চাহিদা থাকায়
প্রধান প্রধান তৈরিকারক দেশগুলোর বাইরে বিকল্পের খোঁজে ক্রেতারা
বিশ্বব্যাপী তৎপর । এ কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এখন এ শিল্পে বিনিয়োগ
করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান এ খাতে বিনিয়োগ
করেছে। বসুন্ধরা গ্রুপ, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, আনন্দ শিপ বিল্ডার্স,
নারায়ণগঞ্জ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড শিপ বিল্ডার্স, খান বিল্ডার্স, হাইস্পিড
গ্রুপ, কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড, খুলনা শিপইয়ার্ডসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ
সেক্টরে এসছে। এ খাতের সংশ্লিষ্ট রড, স্টিল, পার্টস ও অনেক উৎপাদন
শিল্প এ সেক্টরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বসুন্ধরা স্টিল অ্যান্ড
ইঞ্জিনিয়ারিং লি., বসুন্ধরা স্টিল কমপ্লেক্স লি. বসুন্ধরা ড্রেজিং কোং
লিমিটেডের মাধ্যমে এ সেক্টরে বিনিয়োগ করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। রপ্তানি
তালিকায় সম্ভাবনাময় নতুন পণ্য হিসেবে ২০০৮ সালের ১৫ মে সমুদ্রগামী জাহাজ
রপ্তানি শুরু হয়। এরপর অনেক জাহাজ এ দেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি
হয়েছে। আগামিতে রপ্তানি আরও বাড়বে বলে এ খাতের ব্যবসায়ীরা মনে করছেন।
সেজন্য তারা সরকারি সহযোগিতা কামনা করছেন।