২৭ নভেম্বর, ২০১১

স্ত্রীর কবরের পাশে ২৭ বছর

ভালোবাসার ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী  পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের বাকপুর গ্রামের হাফিজউদ্দিন (৮১) দীর্ঘ ২৭ বছর স্ত্রীর কবরের পাশে কাটাচ্ছেন। পারিবারিক চাপে স্ত্রীর কবর কাছ থেকে ফিরে আসলেও বাড়িতে ফেরেননি তিনি। গত ৬ বছর থেকে বাড়ির বাইরে কবরের আদলে তৈরি করা ঘরে অবস্থান করছেন। স্ত্রীর আত্মার সান্নিধ্য লাভের আশায় পার্থিব জগতের আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস আর চাওয়া-পাওয়া ত্যাগ করেছেন তিনি। সহধর্মিনীর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার বেদনা বিধুর অমলিন স্মৃতিকে ধরে রাখতেই তার এই আত্মত্যাগ। বিয়ের ১৯ বছরের মাথায় স্ত্রী শুকুরী বেগম মারা যায়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকেই নির্জন গোরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে জীবিত লাশ হয়ে সহাবস্থানের চেষ্টায় রত ছিলেন হাফিজ উদ্দীন। এমন বিরল ঘটনা পৃথিবীতে সম্ভবত এটিই প্রথম। ভালোবাসার জন্য জীবন্ত লাশ হয়ে নির্জন গোরস্থানে স্ত্রীর কবরের কাছে সময় কাটানোর কঠিন এ ব্রত সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার নিদর্শনকেও হার মানিয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। ১৯৪৯ সালে পারিবারিক ব্যবস্থায় বাড়ির পাশেই বিয়ে করেন ৬ বছরের শুকুরী বিবিকে। বিয়ের পর ৭/৮ বছর স্ত্রী শুকুরী ছিলেন হাফিজউদ্দিনের মা সূর্য্য বানু বিবি’র সঙ্গে। এরপর ১৯৫৬ সালের দিকে দু’জনের সংসার শুরু হয়। এভাবে কেটে যায় ১৯ বছর। শুকুরী বিষয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে অশীতিপর হাফিজ জানান, “মৃত্যুর আগের রাতে বিবি আমার কাছে মিষ্টি খেতে চেয়েছিল। আমি মিষ্টি এনেছিলাম। রাতে দু’জনে মিলে সে মিষ্টান্ন খেয়েছি। সে রাতে অনেক কথা হয়েছে দু’জনাতে। একপর্যায়ে হঠাৎ সে বলা শুরু করে- ‘আমার জন্য কানবেন না, আমি থাকব না।’ এমন কথা বলে রাত গড়িয়ে পরদিনই বিবি আমার হাঁটুতে মাথা রেখে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে।”
 স্ত্রীর আত্মার সান্নিধ্য লাভের আশায় এবং পরজগতে প্রেমসম্রাজ্ঞী বিবি শুকুরীর সঙ্গে পুনর্মিলনে ব্যাকুল হাফিজউদ্দিন স্ত্রীর আত্মার খোঁজে একপর্যায়ে গৃহত্যাগ করেন। ১৯৭৮ সালের দিকে হাফিজউদ্দিন নিজগ্রামে ফিরে আসেন। ওই সময়ের অগ্রহায়ণ মাসের ২ তারিখ হাফিজউদ্দিন স্ত্রীর কবরের পাশে গিয়ে আশ্রয় নেন। এরপর থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত একটানা ২৭ বছর স্ত্রীর কবরের পাশে ছাপরা ঘর তুলে বসবাস করেন হাফিজউদ্দিন। ওই দীর্ঘ সময়ে বনজঙ্গলে ঘেরা নির্জন কবরস্থানে বাঘ, সাপসহ হিংস্র জীবজন্তুর ভয়ভীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়েছে। অথবা বলা যায়, ওইসব দুর্যোগও সসম্ভ্রম সম্মানে এড়িয়ে গেছে এই পাগল প্রেমিককে। বিরক্ত করেনি আত্মমগ্ন এই ঋষিকে। তবে ২০০৬ সালে পারিবারিক চাপে শুকুরীর সমাধী ছেড়ে আসতে হয়েছে হাফিজকে। বাড়ির বাইরে কবরের আদলে তৈরি করা ঘরে বর্তমানে অবস্থান করছেন হাফিজউদ্দিন। ওই কবরেই তাকে সমাহিত করার কথা বলে রেখেছেন স্বজনদেরকে। হাফিজউদ্দিন আরো বলেন, “সংসার জীবনে আমরা একে অন্যকে ছাড়া কখনও ছিলাম না। বিয়ের পর থেকে একাত্ম হয়ে একমন নিয়ে দু’জন দু’জনকে অনুভব করতাম। কেউ কাউকে কষ্ট দেইনি। কখনো বাড়ির বাইরে গেলে সারাক্ষণ তার জন্য এক ধরণের অস্থিরতা অনুভব করতাম।” যতদিন আমি বেচে আছি ততদিন আমি তার আত্মার সন্ধান করে যাব।