১৯৭১
সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গর্বের একটি দিন। আর
স্বাধীনতা লাভের এই দিনটি অর্জন করতে আমাদেরকে অনেক ত্যাগের পথ পাড়ি দিতে
হয়েছে। এর শুরুটা হয়েছিল ২৬ মার্চ থেকে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা
আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করেছি। স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের
সবচেয়ে বড় এই অর্জনকে নতুন প্রজন্ম তথা সারা দেশের মানুষের কাছে স্মরণীয়
করে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এদেশের গণমাধ্যম। বাংলাদেশ বেতার,
বাংলাদেশ টেলিভিশন এমনকি আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের জয়গান করা
হয়েছে। নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশের আপামর জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের
চেতনায় উজ্জীবিত করতে ভূমিকা রেখেছেন ছোট ও বড়পর্দার নির্মাতারা। তবে কতটা
পেরেছেন সে প্রশ্নটা এখানেই। এসব বিষয়ে নিয়েই এবারের মূল ফিচার লিখেছেন
রকিব হোসেন। নয় মাসে স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস পৃথিবীর বুকে আর কোনো
জাতি রচনা করতে পারেনি। শুধু আমরাই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলাম। আর তাই
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এদেশের মানুষের আবেগ ও অনুভূতিটা একটু বেশিই। স্বৈরাচারী
পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে আমাদেরকে
অনেক ত্যাগের সাগর পাড়ি দিতে হয়েছে। এরপরই আমরা পেয়েছিলাম আমাদের পরম
আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের স্বাধীনতা। একজন বাঙালি হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা দেশের আপামর জনতা সব সময়ই হূদয়ের গভীরে লালন করেন। তেমনি প্রতিটি
শিল্পী তার নানা কাজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছেন ভিন্নমাত্রায়।
আমাদের গণমাধ্যমও এর ব্যতিক্রম নয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা
বেতার কেন্দ্র যেমন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছে তাদের নানা
পরিবেশনার মাধ্যমে, তেমনি স্বাধীনতা পরবতর্ী সময়েও বাংলাদেশ বেতার
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে
দিতে নানারকম ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি একই অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ
টেলিভিশন। বিশেষ করে আমাদের টিভি নাটকে মুক্তিযুদ্ধকে অনেক যত্নের সাথে
তুলে ধরেছেন নির্মাতারা। তবে, আমাদের অহংকারের মুক্তিযুদ্ধকে যথাযথভাবে
তুলে ধরার জন্য গণমাধ্যম হিসেবে একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে দেশীয়
চলচ্চিত্র।
বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র হিসেবে
মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত 'ওরা এগারো জন'। ছবির অধিকাংশ
কলাকুশলী ছিলেন সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত বাংলার সূর্যসন্তান। দর্শক টান টান
উত্তেজনা নিয়েই উপভোগ করেছে ছবিটি। এছাড়াও মুক্তি পায় সুভাস দত্তের
'অরুণোদয়ের অগি্নসাক্ষী', 'মমতাজ আলীর 'রক্তাক্ত বাংলা' ও আনন্দের 'বাঘা
বাঙালি' দেখেছে। যুদ্ধাহত নবীন বাংলাদেশে যুদ্ধের পরের বছরই এ
চলচ্চিত্রগুলো মুক্তি পায়। মুক্তিযুদ্ধের তাণ্ডবের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত
সবাই তখন পর্দায় উপভোগ করে তাদের কীর্তিগাঁথা। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায়
আলমগীর কবিরের 'ধীরে বহে মেঘনা'। এ বছরই 'আমার জন্মভূমি' ছবিটি নির্মাণ
করেন আলমগীর কুমকুম। খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন 'আবার তোরা মানুষ হ'।
যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের সাধারণ জীবনে ফিরে এসে দেশ গঠনের কাজে নিয়োজিত
হওয়ার আহ্বান করা হয়েছে এ ছবিতে। ১৯৭৩ সালে এই তিনিটি ছবির পর ১৯৭৪ সালে
চাষী নজরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দ্বিতীয় চলচ্চিত্র 'সংগ্রাম' মুক্তি
পায়। '৭৪ সালে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরেকটি ছবি, মিতা পরিচালিত
'আলোর মিছিল'। ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় হারুনুর রশীদ পরিচালিত 'মেঘের অনেক
রঙ'। '৭০-এর দশকেই নির্মিত হয় ফখরুল আলম পরিচালিত 'জয় বাংলা', এস আলী
পরিচালিত 'বাঙালির ছাবি্বশ বছর'। অোলমগীর কবির নির্মাণ করেছেন 'এক সাগর
রক্তের বিনিময়ে' আর শহীদুল হক খান নির্মাণ করেছেন 'কলমীলতা'। নব্বইয়ে দশকে
এসে বেশ কিছু গুণী চলচ্চিত্রকার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ ভালো কিছু চলচ্চিত্র
তৈরি করেছেন। তারেক মাসুদ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের পর নির্মাণ
করলেন 'মুক্তির গান'। প্রশংসিত হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের ছবি 'আগুনের পরশমণি' ।
তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না' ছবিটি সব মহলে প্রশংসিত হয়। আর এটাই
বাংলাদেশের প্রথম অস্কারের জন্য মনোনীত কোনো চলচ্চিত্র। এতে মুক্তিযুদ্ধ
উঠে এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তৃতীয় ছবি 'হাঙর নদী গ্রেনেড'। ২০০৪ সালে মুক্তি পায়
হুমায়ূন আহমেদের 'শ্যামল ছায়া' আর তরুণ নির্মাতা তৌকীর আহমেদের
'জয়যাত্রা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র 'খেলাঘর'। এতে
মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি দেখানো হয়নি একবারও, তবুও যুদ্ধের উত্তাপ ছিল প্রতি
মুহূর্তে। 'খেলাঘর' চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন মোরশেদুল ইসলাম।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এরকম বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে আমাদের দেশে। যদিও
বিশ্বমানের চলচ্চিত্র খুব একটা হয়নি বলেই অনেক চলচ্চিত্র সমালোচকদের
ধারণা। তবুও সব নির্মাতাই চেষ্টা করেছেন নিজ নিজ জায়গা থেকে। ১৯৭১ সালে
মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ই প্রগতিশীল চলচ্চিত্র নির্মাতারা
মুক্তিযুদ্ধের ওপর কিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। জহির রায়হান
নির্মাণ করেন অনন্য ছবি 'স্টপ জেনোসাইড', যা বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে
জনমত তৈরি করে। মুক্তযুদ্ধ চলাকালীন অন্য চলচ্চিত্রগুলো হলো_আলমগীর কবিরের
'লিবারেশন ফাইটাসর্', শুকদেবের 'নাইন মান্থস টু ফ্রিডম' ও বাবুল চৌধুরীর
'ইনোসেন্ট মিলিয়নস'। যুদ্ধের ময়দান থেকেই বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য
চলচ্চিত্রের সঙ্গে সঙ্গে প্রামাণ্যচিত্রের ইতিহাস শুরু হয়। ১৯৭২ সালে
নির্মিত হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ'। ১৯৮৪ সালে
নির্মিত হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'আগামী', ১৯৮৬ সালে 'প্রত্যাবর্তন'।
এর পরিচালক ছিলেন মোরশেদুল ইসলাম। আর এই গুণী পরিচালকের হাতেই ১৯৮৮ সালে
নির্মিত হয় 'সূচনা'। ১৯৮৯ সালে আক্তার হোসেন নির্মাণ করলেন 'দূরন্ত'। ১৯৯০
থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরে নির্মিত হয়েছে আরো বেশ কিছু
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ১৯৯০ সালে নির্মিত হয় 'একজন
মুক্তিযোদ্ধা' ও 'ধূসর যাত্রা'। ১৯৯৩ সালে নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্মাণ করেন
'একাত্তরের যীশু'। ২০০৪ সালে তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন 'স্মৃতি ৭১'।
এর আগের বছর কাওসার চৌধুরী তৈরি করেন 'সেই রাতের কথা বলতে এসেছি'। এ
স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিটি দর্শক ও সমালোচকদের কাছে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। ১৯৮৪ সাল
থেকে এ পর্যন্ত আমাদের দেশে প্রায় শ'খানেক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
নির্মিত হয়েছে। আর এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে
ঘিরে।
এবং গেরিলা
নাসির উদ্দীন ইউসুফের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নতুন ছবি 'গেরিলা' এরইমধ্যে সেন্সর ছাড়পত্র লাভ করেছে। চলচ্চিত্রটি এখন মুক্তির প্রহর গুনছে। অনেকে ধারণা করছেন এ চলচ্চিত্রটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরবে। এ চলচ্চিত্র নিয়ে পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, 'সৈয়দ শামসুল হকের 'নিষিদ্ধ লোবান' উপন্যাস এবং মুক্তিযুদ্ধে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে তৈরি করেছি ছবিটি। চিত্রনাট্য করেছি যৌথভাবে আমি ও এবাদুর রহমান। ছবিতে দর্শকেরা মুক্তিযুদ্ধ ও চলচ্চিত্র নিয়ে আমার ভাবনার জায়গাটা পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। তবে ছবিটি কেমন হবে, তা দেখার পর দর্শকই বলতে পারবেন।' নাসির উদ্দীন ইউসুফ জানান, ছবিটির শুটিং-পরবতর্ী কাজের জন্য বিভিন্ন পযর্ায়ে মোট ৩৩ দিন মুম্বাইতে থাকতে হয়েছে তাকে। ছবিতে অভিনয়করেছেন জয়া আহসান, শতাব্দী ওয়াদুদ, এটিএম শামসুজ্জামান, ফেরদৌস, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
বোদ্ধাদের অভিমত
স্বাধীনতার
পর ১৯৭২ সালে নির্মিত 'ওরা এগারোজন' থেকে সর্বশেষ 'গেরিলা'_ সব
চলচ্চিত্রেই মুক্তিযুদ্ধকে নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন
করা হয়েছে। আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক চলচ্চিত্রই
নির্মিত হয়েছে। কখনো প্রত্যক্ষ আবার কখনো পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে
এ দেশীয় চলচ্চিত্রে। প্রামাণ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র এবং পূর্ণাঙ্গ
কাহিনিচিত্র _এ তিন ধরনের চলচ্চিত্রই নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের
প্রেক্ষাপটে আমাদের সেরা অর্জন স্বাধীনতা। আর এই অর্জনের জন্য
মুক্তিযোদ্ধারাসহ গোটা বাঙালি যে অপরিসীম ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেছে সে
কাহিনি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে বারবার। তবে, মুক্তিযুদ্ধকে কতটা সফলভাবে
গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এ প্রসঙ্গে
বিটিভির প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকের রচয়িতা ড. ইনামুল হক বলেন,'
সত্যি বলতে কী, আমাদের গণমাধ্যমে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম মুখর
সময়গুলো উঠে আসা দরকার ছিল, তা আসেনি। আমরা কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ
নিয়েছিলাম, তার উদ্দেশ্য আমাদের গণমাধ্যমে যতটা যথাযথভাবে তুলে ধরা উচিত
ছিল তা হয়নি। তবে, এ ক্ষেত্রে নাটকে যা উঠে এসেছে, তাতে খানিকটা সন্তুষ্টি
এলেও আমাদের চলচ্চিত্রে তা কিছুই আসেনি। তবে, একটি চলচ্চিত্রের কথা না
বললেই নয়, আর তা হলো হুমায়ূন আহমেদের 'আগুনের পরশমণি'। এ ছবিতে
মুক্তিযুদ্ধকালীন পারিবারিক অসহায়ত্বের দিকগুলো চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা
হয়েছে। আসলে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কারণে এ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক
ইচ্ছে থাকলেও তুলে ধরা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে যদি বেতারের কথা বলি, এ
মাধ্যমটি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত
করেছে তাদের পরিবেশনা দিয়ে। স্বাধীনতা লাভের পর এই মাধ্যমটির প্রতি অনেকটা
অবহেলাই করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়। পাশাপাশি এখন এফএম রেডিওতে
মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরার কাজ তেমন চোখে পড়ে না। আমার মনে হয়, তরুণ
প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধকে সুন্দর করে উপস্থাপনে এই মাধ্যমটিও ভূমিকা
রাখতে পারে।' একটু ভিন্নমত পোষণ করে খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নিমর্াতা চাষী
নজরুল ইসলাম বলেন,' সামগ্রিক অর্থে যদি বলি, তা হলে বলতে হয়, আমাদের
গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে আমরা তেমন করে তুলে ধরতে পারিনি। তবে, আমাদের
চলচ্চিত্রে অনেকটাই উঠে এসেছে। 'আবার তোরা মানুষ হ' চলচ্চিত্রে খান আতাউর
রহমান আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে দারুণ করে উঠিয়ে এনেছেন। আমরা এখন যা বলছি, আতা
ভাই তা অনেক আগেই বলে গেছেন। সত্যি বলতে কী, এটা আমাদেরই ব্যর্থতা যে,
গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়ে ওঠেনি। আর কারণ, আমাদের
মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি অর্থনৈতিক বিভাজনও রয়েছে। আমরা আজ সত্যকে
সত্য বলে মেনে নিতে পারছি না রাজনৈতিক কারণে।' একটু দম নিয়ে চাষী আবার
বলেন,'আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ছবি হয়েছে_বেশিরভাগ ছবিতেই
মুক্তিযুদ্ধকে স্রেফ একটি বিষয় হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা অত্যন্ত বেশি
ঘটেছে বলে আমার মনে হয়। আমরা কোনো পরিচালকই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের
সংকট, যুদ্ধ পরবতর্ী সময়ে দেশের অবস্থা এবং একটি দেশের জন্মদানের পরের
অবস্থাগুলো ছবিতে তুলে আনার ব্যাপারে চেষ্টা করিনি। ফলে মুক্তিযুদ্ধকে আমরা
আজো ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। এই অবস্থা এ কারণেই ঘটেছে বলে আমার মনে
হয়_মানুষের মধ্যে নিজের দেশের প্রতি যে ভালোবাসা থাকে সেই দেশপ্রেমটাই
আমরা প্রতিদিন হারিয়ে ফেলছি এবং ফেলেছিও। ফলে ২৬ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বর
এলেই কেবল আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মেতে উঠি। আর এই দিনদুটো চলে গেলে আবারো
আমরা দেশের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে দেশ ও দশের ক্ষতি করতে লেগে যাই।
আমাদের
যুদ্ধের ইতিহাসটাতো আসলে বাঙালি জাতিরই ইতিহাস। এই প্রজন্ম এই ইতিহাস
জানতে খুবই আগ্রহী। 'ওরা ১১ জন' ছবিটি ডিভিডিতে দেখে অনেক নতুন ছেলেমেয়ে
আমাকে ফোন করে। আর তারা জানতে চায়, আসলেই কি এত দুঃখের অতীত আমরা পার
করেছি? আমি যখন বলি তারা আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। আর এই ছবিগুলোর মাধ্যমে
আমাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং সচেতনতা তৈরি হবার মাধ্যমে আমার মনে
হয়_এখানকার রাজনৈতিক এবং বা সামাজিক সমস্যাগুলো অনেকটাই কমে যাবে। আর
গণতন্ত্র সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে বাস্তবতা হলো- এই দেশে যে'কটি
যুদ্ধনির্ভর ছবি হয়েছে সেগুলোর খুব কমই এসব নতুন ছেলেমেয়েরা দেখেছে।
স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস এলেই দু'একটি ছবি চালানো হয়। সারা বছর কোনো খোঁজ
থাকে না। এখন দেশে অনেক চ্যানেল। এই চ্যানেলগুলো যদি মাসে অন্তত একটি করেও
মুক্তিযুদ্ধের ছবি দেখায় তাহলেও নবীনদের খুব উপকার হবে। দেশেরও ভালো হবে।
আর মুক্তিযুদ্ধকে আমাদের চলচ্চিত্রে যথাযথভাবে তুলে ধরতে সরকারের
পৃষ্ঠপোষকতা অনেক প্রয়োজন।' চাষী নজরুল ইসলাম আরো বলেন, 'সত্যিকার অর্থে
যদি সরকার কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র আগ্রহী হতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
বাস্তবায়নে_তা হলে অবশ্যই তারা এ বিষয়ে ছবি নিমর্াণের জন্য আমাদের বলতেন।
দরকারি পদক্ষেপগুলো নিতেন। কারণ, মানুষের কাছে পেঁৗছানোর সবচেয়ে সহজ মাধ্যম
সিনেমা_এটা সবাই জানেন। এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে আমরা এই জাতির সবচেয়ে বড়
অর্জনের কথা খুব সহজেই মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি। তাকে আমাদের দেশের
জন্ম বৃত্তান্ত জানিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। আর এটা করা এখন খুবই
সহজ। কারণ, আমাদের প্রযুক্তির পাশাপাশি ভালো পরিচালকেরও অভাব নেই। কিন্তু
আমাদের সরকারগুলোর এ ধরনের কোনো আগ্রহ নেই বলে আমার প্রায়ই মনে হয়।' তার
সাথে যোগ করে বরেণ্য অভিনেতা পরিচালক আবুল হায়াত বলেন,' নাটক চলচ্চিত্র যাই
বলি কেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে গেলে আমাদের এই গণমাধ্যমে প্রেমজনিত
বিষয়গুলোই যেন উঠে আসে বারবার। অথচ মুক্তিযুদ্ধকালীন আমরা কত ক্রাইসিসেই না
পড়েছি। আর সেই বিষয় আমাদের কাজে তেমনভাবে তুলে ধরা হয় না। অবশ্য এর পেছনে
অনেক যৌক্তিক কারণও রয়েছে। তা হলো এ ধরনের কাজে যে বাজেট থাকা দরকার, তা
পাওয়া যায় না যথাযথ। একটি যুদ্ধের দৃশ্য করতে গেলে যে ধরনের প্রপস বা
লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন তা পাওয়া যায় না। তাই, অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও
নিমর্াতারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন না।'