স্বাধীনতার ঘোষক কে? বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান না
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সেক্টর কমান্ডার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান?
প্রশ্নটি স্বাধীনতার এতো বছর পরেও ঝুলে আছে। কেউ কেউ বলেন স্বাধীনতার ঘোষণা
হয়েছিলো সাত মার্চেই। আবার কেউ কেউ বলেন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকেই
স্বাধীনতার চরম ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস কোনটি? আর বিকৃত
ইতিহাস কোনটি? কোন ইতিহাসটি স্বাধীনতা পরবর্তি প্রজন্ম বেছে নেবে? একটি
সঠিক ইতিহাস বের করতে এতো সময় লাগার কথা না। নাকি যুগে যুগে যারা এ দেশের
দায়িত্বভার বহন করেছেন তাদের ইতিহাস বিকৃতির মনোবৃত্তির ফলেই এই সঠিক
ইতিহাসটি তুলে আনা সম্ভব হয়নি?
বিগত এরশাদ সরকার (আমরা যাকে
স্বৈরাচার সরকার বলি) ক্ষমতায় থাকাকালিন সময়ে এনিয়ে তার বা তার মন্ত্রীদের খুব
একটা মাথাব্যাথা ছিলোনা বলে মনে হয়। তখন ইতিহাস সচেতন মানুষগুলোকেও খুব
একটা মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি বিষয়টি নিয়ে। স্বৈরশাসকের পতনের পর
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদি দল (বিএনপি) ক্ষমতায় আসলে তাদের সেই সময়ের কিছু মন্ত্রী এমপি বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামান এবং
সেই সময়ে খোদ বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিও স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে
শেখ মুজিবর রহমানের নাম উচ্চারণ করতেন। তবে পার্লামেন্টে এই বিষয়টি নিয়ে
মৃদু গুঞ্জন উঠলেও তাতে তেমন কোন প্রভাব পড়েছিলোনা ইতিহাসের উপর। কিন্তু
সেই সময়ের কিছু ইতিহাসবিদগণ তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন
হওয়ার জন্য ইতিহাস বইতে স্বাধীনতা ঘোষণার নায়ক বানিয়ে দেন জিয়াউর রহমানকে।
হঠাৎ ইতিহাসের পরিবর্তন দেখে কিছু অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের বলে দেন যে
না বইয়ে ভুল লেখা হয়েছে, সঠিক ইতিহাস হলো এই। এ পরিবর্তনের ফলে জনমনে
ছাত্র-শিকদের মধ্যে দ্বিমতের সৃষ্টি হয়। আর এই ইতিহাসের পরিবর্তন করা হয়
একেবারেই প্রাথমিক শিক্ষার বইয়ে ফলে অন্তত ওই পাঁচ বছর ইতিহাসে স্বাধীনতার
ঘোষক হিসেবে স্থান পায় জিয়াউর রহমানের নাম। জানতে বাধ্য করা হয় একটা
প্রজন্মকে যে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান।
ঠিক পাঁচ বছর পরে
স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি শেখ মুজিবর রহমানের হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়। আর তার পরপরই প্রতিটি বইয়ের পাতা থেকে স্বাধীনতার ঘোষক
হিসেবে মুছে ফেলা হয় জিয়াউর রহমানের নাম।
সেখানে স্থান করে নেয় শেখ মুজিবর
রহমানের নাম। আবারো আরো একটা প্রজন্মকে জানতে বাধ্য করা হয় নতুন ইতিহাস। আর
এ ইতিহাসেই চলে পাঁচ বছর। সময় গড়িয়ে যায় আবারো পরিবর্তন হয় ক্ষমতার। এবার
ক্ষমতায় বসে চার দলিয় জোট সরকার। শুরু হয় আবারো ইতিহাস পরিবর্তনের কাজ। বইয়ের
পাতায় লেখা হয় স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে জিয়াউর রহমানের নাম। এই চারদলীয় জোট
সরকারের সাথে শরিকদল হিসেবে মতায় আসে সরাসরি স্বাধীনতার বিপ শক্তি জামায়াতে
ইসলামি। নতুন করে ইতিহাস বিকৃতির রেকর্ড গড়া হয় এ সময়ে। তখন পরিস্থিতি
ছিলো আরো ভয়াবহ। পারলে মতিউর রহমান নিজামী দাবি করে বসেন যে তিনিই
স্বাধীনতার ঘোষক। আবারো একটা প্রজন্মকে বাধ্য করা হয় বিকৃত ইতিহাস পড়তে।
সর্বশেষ
পরিবর্তনের দুবছর পূবে ক্ষমতায় থাকেন তদারকি সরকার ফখরুদ্দিন আহমেদ এবং
মঈন ইউ আহমেদ। সেই সময়ে ইতিহাস সঠিক ছিলো না বেঠিক ছিলো তা ইতিহাসবিদরাই
ভালো বলতে পারবেন। দু’বছর পর আবারো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। আবারো পরিবর্তন
করা হয় ইতিহাস, স্থান করে নেয় শেখ মুজিবর রহমানের নাম। এই পাঁচ বছরের
ইতিহাসের পাতায় হয়তো এ নামই থাকবে। কিন্ত আগামী পাঁচ বছরে কি হবে? আবারো কি
পরিবর্তন হবে এই ইতিহাস? হ্যাঁ বিগত দিনের ইতিহাস থেকে তা সহজেই অনুমান
করা যায়। তাহলে এর সঠিক ইতিহাস কোনটি? প্রতি পাঁচ বছর পর পর একেকটি
প্রজন্মকে একেক ইতিহাস শিক্ষা দিলে কেউই জানতে, বুঝতে পারবে না একদম সঠিক
কোনটা? দ্বিমতের জায়গা ইতিহাসবিদগণই তৈরী করে দিচ্ছেন পাঁচ বছর পর পর। যারা
এই পরিবর্তনের কাজে নিয়োজিত তারা নিজেরাই জানেনতো সঠিক ইতিহাস কোনটি?
উনারা যদি না জানেন তাহলে এই পরিবর্তনের খেলা বন্ধ করতে হবে। মানুষকে
জানাতে হবে সঠিক ইতিহাস, বন্ধ করতে হবে ইতিহাস বিকৃতির এই ক্রমধারা।