৩০ জুন, ২০১১

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত

সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করল জাতীয় সংসদ। এ সংক্রান্ত দুটি দফা সম্বলিত পঞ্চদশ সংশোধনীর বিল পাসের মধ্য দিয়ে নির্দলীয় এই সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হল। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ৫২মিনিটে চলতি ৯ম অধিবেশনের ২৭তম কার্যদিবসের আইন প্রণয়ন পর্বে বিভক্তি ভোটে ওই বিলটি পাস করা হয়। বিলের পক্ষে ২৯১ টি এবং বিপক্ষে ভোট পড়ে মাত্র ১টি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই বহুলালোচিত সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল। এ সময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রায় সকল সদস্য সংসদে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বেলা ১১ টা ৫২ মিনিটে বিলটি পাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আইন প্রণয়ন পর্বের শুরুতে স্পিকার আব্দুল হামিদ এডভোকেটের আহবানে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ স্থায়ী কমিটির সুপারিশ সম্বলিত সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) বিল-২০১১ বিবেচনার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এরপর একমাত্র স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মো. ফজলুল আজিমের দেয়া জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাব এবং বিলটির সাধারণ নীতির উপর সাধারণ আলোচনা ও ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ফজলুল আজিম তার প্রস্তাব উত্থাপনকালে বলেন, এই বিলের সবচেয়ে বড় সমস্যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি। এ নিয়ে জাতি বিভক্ত হবে। এ ধরণের সংশোধনী সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে। এই দেশের মানুষ আর কোনদিন এ ধরণের রাজনৈতিক দলকে সুযোগ দেবে না। এর আগে তিনি বলেন, এই বিলে বেশ কিছু মৌলিক বিষয়ে হাত দেয়া হয়েছে। যেভাবে তড়িঘড়ি করে এটা চূড়ান্ত করা হল তা কারো কাম্য ছিল না। তিনি প্রশ্ন রেখে আরো বলেন, কেন এত হুলুস্থুল করা হল? এত তাড়া কিসের? এর জবাব দিতে গিয়ে মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক বলেন, সামরিক ফরমান দিয়ে কিভাবে সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছিল তা উনি (ফজলুল আজিম) ভুলে গেছেন। তিনি দাবি করেন, আজিমের জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাব ভিত্তিহীন। এর কোন প্রয়োজন নেই। এরপর কণ্ঠভোটে বিলটি গ্রহণ করা হয়। এর আগে এসব প্রস্তাব সম্পর্কে মাত্র ৫ মিনিট কথা বলার সুযোগ দেয়ায় ওয়াকআউট করেন ফজলুল আজিম। মাত্র ২ মিনিট পরেই অধিবেশন কক্ষে ফেরত আসেন তিনি। এরপর বিলের উপর আনীত ৬৫টি সংশোধনী প্রস্তাব কন্ঠভোটে নাকচ করে এর প্রতিটি ধারা বিভক্তি ভোটে নিস্পত্তি করা হয়। এর আগে এগুলো নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মো: ফজলুল আজিম সর্বোচ্চ ২৩টি, মহাজোট শরীক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ৭টি , একই দলের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ৪টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ৫টি, একই দলের সংসদ সদস্য শাহ জিকরুল আহমেদ ৫টি, মইন উদ্দিন খান বাদল ১৪ টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)'র আমেনা আহমেদ ৪টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর বিলের উপর আনীত ৬৫টি সংশোধনী প্রস্তাব কন্ঠভোটে নাকচ করে এর প্রতিটি ধারা বিভক্তি ভোটে নিষ্পত্তি করা হয়। এর আগে এগুলো নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মো. ফজলুল আজিম সর্বোচ্চ ২৩টি, মহাজোট শরীক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ৭টি, একই দলের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ৪টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ৫টি, একই দলের সংসদ সদস্য শাহ জিকরুল আহমেদ ৫টি, মঈন উদ্দিন খান বাদল ১৪টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)'র আমেনা আহমেদ ৪টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার ও সাবের হোসেন চৌধুরী ১টি করে সংশোধনী নিয়ে কথা বলেন। পরে এসব সংশোধনী প্রস্তাবেরও জবাব দেন আইনমন্ত্রী। সংশোধনী প্রস্তাব কন্ঠভোটে নাকচ করার পর ২য় ও প্রতিটি ধারা বিভক্তি ভোটে নিস্পত্তি করার পর ৩ দফা ওয়াকআউট করেন ফজলুল আজিম। প্রতিবারই ১ মিনিট পর অধিবেশন কক্ষে ফিরে আসেন তিনি। প্রায় দেড় ঘন্টার এই প্রক্রিয়া শেষে পূর্ণাঙ্গ বিলটিও প্রথমে কন্ঠভোটে এবং পরে বিভক্তি ভোটে পাস করা হয়। এর আগে স্পিকার বিভক্তি ভোটের ঘোষণা দিয়ে ২ মিনিট ঘণ্টা বাজানোর নির্দেশ দেন। এরপর সাংসদেরা তাঁদের জন্য নির্ধারিত লবিতে চলে যান। এ সময় লবির বাইরের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। সংসদ সচিবালয়ের ৪ কর্মকর্তা এ ভোটের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পরে স্পিকার এই ভোটের ফলাফল ঘোষণা করেন। এ সময় ৪র্থ ও শেষ দফা ওয়াকআউট করে অধিবেশন কক্ষে আর ফেরেননি ফজলুল আজিম। বিল পাশের পর সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীকে ফ্লোর দেন স্পিকার। সংসদ নেতার বক্তব্যের আগে স্পিকার বলেন, এয়াবত সংবিধান সংশোধন বিল পাস হয়েছে রাতে। এবারই প্রথম এ বিল পাস হলো দিনের আলোয়। বিলটির ২১তম দফায় বলা হয়েছে "সংবিধানের '২ক পরিচ্ছেদ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার' বিলুপ্ত হইবে।" বর্তমানে সংবিধানের এই পরিচ্ছেদে মূলত ৫৮(খ), ৫৮(গ), ৫৮(ঘ) ও ৫৮(ঙ) অনুচ্ছেদ রয়েছে। আর এসব অনুচ্ছেদেই তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধানগুলো রয়েছে। ওদিকে- বিলের ২০তম দফায় সংবিধানের ৫৮ক অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আগে 'নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকালে কতিপয় বিধানের অপ্রয়োজনীয়তা' শিরোনামে দেয়া ২১ নম্বর সুপারিশে এই অনুচ্ছেদটি বিলুপ্তি করতে বলেছিল সদ্য বিলুপ্ত সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি। বিলের ৪৫তম দফায় প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পদ বিলুপ্ত করে ১৪৭ অনুচ্ছেদ সংশোধনের এবং ৪৭তম দফায় ১৫২ অনুচ্ছেদ থেকে পদ দুটির সংজ্ঞা বিলুপ্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। এবারের সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ায় এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি মন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ। এখানে শুধু অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতাগ্রহণকারীদের শাস্তি প্রদান ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী দাবি করেছেন, সংবিধান সংশোধনের এই বিলটি আইনে পরিণত হলে তা 'জনগণের রাজনৈতিক ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষণে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।' সদ্য পাস হওয়া এই সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) বিল-২০১১ রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে আইনে পরিণত হওয়ার পর সংশোধিত সংবিধান মুদ্রণের কাজ শুরু করবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সংবিধানের এই সংশোধনী পাসের ফলে আগামী সংসদ নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। আগে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান ছিল। সংসদের মেয়াদের শেষ ৯০ দিন হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থাৎ ওই সময়ে বর্তমান মন্ত্রিসভাই বহাল থাকবে। তবে তারা শুধু রুটিন (নিয়মিত) কাজ করবে। রাষ্ট্রপতির পরামর্শে নির্বাচন পরিচালনার মূল কাজ করবে নির্বাচন কমিশন। ওই ৩ মাসে সংসদ থাকলেও অধিবেশন বসবে না। প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল। গত ৩টি জাতীয় নির্বাচন এই সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বুধবার সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) বিল-২০১১ এর প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করে সংসদীয় কমিটি। গত ২৫ জুন এটি উত্থাপন করেছিলেন মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। গত ২০ জুন এই বিলটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়। উল্লেখিত বিশেষ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিলটি প্রস্তুত করা হয়। গত ৮ জুন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলসহ ৫১টি সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করে বিশেষ কমিটি। এরপর এসব সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রতিবেদনটি আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের নির্দেশ দেন স্পিকার। এরই প্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের ঐক্যমত ছাড়াই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংক্রান্ত বিল প্রস্তুতের প্রক্রিয়া শুরু হয়। মন্ত্রিসভা এ বিলের অনুমোদন দেয়ার পর সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদ অনুসারে এটি সংসদে উত্থাপনের অনুমতি দেন রাষ্ট্রপতি মো: জিল্লুর রহমান। (সূত্র: শীর্ষ নিউজ ডটকম)