'ভাঁড়-ভাঁড়'- এ উল্লাস ধ্বনির মধ্যে সিলভিও বার্লুসকোনির পদত্যাগ 'উদযাপন'
করছে ইতালীয়রা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা এ
ধনকুবের অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে ব্যর্থতা নিয়ে চাপের মুখে সরে দাঁড়ালেন।
পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর শনিবার পদত্যাগ করেন
বার্লুসকোনি। অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে অর্ন্তর্বতী একটি সরকার গঠনের
লক্ষ্যেই তার সিদ্ধান্ত। কয়েক দিন আগে পার্লামেন্টে এক
ভোটাভুটিতে কোনোমতে উৎরে গেলেও তা স্পষ্ট করে, সরকার চালানোর মতো
সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর নেই বার্লুসকোনির। এর মধ্যে বিরোধী দল চাপ বাড়াতে থাকায়
পদত্যাগে রাজি হওয়ার কথা জানান তিনি। শনিবার বার্লুসকোনির পদত্যাগের পরপরই রাতে উল্লাসে ফেটে পড়ে ইতালীয়রা। নাচে-গানে রাজধানী রোম মাতিয়ে রাখে তারা। প্রেসিডেন্ট
জর্জিও নাপোলিতানোর কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে আসেন বার্লুসকোনি। প্রেসিডেন্ট
রোববার সন্ধ্যায়ই নতুন প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করতে পারেন বলে ইতালির
সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে। এক্ষেত্রে সাবেক ইউরোপীয় কমিশনার মারিও মন্তির
নামটিই বেশি শোনা যাচ্ছে। ইতালীয়রা আশা করছে, দেনার দায়ে
জর্জরিত অবস্থা থেকে ইউরো অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিকে সঠিক
পথে ফিরিয়ে আনবে নতুন সরকার। ইউরোপসহ বিশ্ব নেতারাও তাই আশা করছেন। পদত্যাগপত্র
জমা দিতে শনিবার সন্ধ্যায় বার্লুসকোনির প্রেসিডেন্ট ভবনে যাওয়ার খবর শুনেই
সেখানে ভিড় জমতে থাকে। এক পর্যায়ে বিশাল হয়ে ওঠে সেই বিক্ষোভ। অবস্থা
বেগতিক দেখে মূল ফটক দিয়ে বের না হয়ে পেছনের দরজা ধরেন বার্লুসকোনি। কিন্তু
তার লিমুজিন গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটতে থাকে বিক্ষোভকারীরা। 'জেল চাই, জেল
চাই'- এ স্লোগান ছিলো তাদের কণ্ঠে। বার্লুসকোনির বাড়ির সামনে
তার কিছু সমর্থক জড়ো হয়েছিলো, কিন্তু সেখানে বিশাল সংখ্যক বিরোধীদের
স্লোগানে চাপা পড়ে যায় তাদের কথা। বিরোধী এক সমর্থক রয়টার্সকে বলেন, "এটি
উল্লাসেরই মুহূর্ত, আর আমরা তা উদযাপন করছি।" প্রেসিডেন্টের ভবন, বার্লুসকোনির বাসভবন ছাড়াও পার্লামেন্ট ভবনের সামনেও উল্লাসে মেতে ওঠেন অনেকে। বিপুল
সমর্থন নিয়ে ১৯৯৪ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন
বার্লুসকোনি। মাঝে বিরতি দিয়ে এরপর আরো দুই বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত
হয়েছিলেন ৭৫ বছর বয়সি এ ব্যবসায়ী। কিন্তু দুর্নীতি ও যৌন কেলেঙ্কারিতে
জড়িয়ে তার বিদায়ের চিত্র ছিলো ক্ষমতায় আরোহণের ঠিক বিপরীত। ইতালির
'মিডিয়া মুঘল' হিসেবে পরিচিত বার্লুসকোনি পদত্যাগের পর কোনো আনুষ্ঠানিক
প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে সংবাদ সংস্থা আনসা বার্লুসকোনিকে উদ্ধৃত করে
জানিয়েছে, বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তার এই পদত্যাগ। ইতালির
অন্যতম ধনী ব্যক্তি বার্লুসকোনি ১৯৯৪, ২০০১ ও ২০০৮ সালে নির্বাচনে জিতে তিন
বার মধ্য ডানপন্থী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। তবে ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালের
নির্বাচনে হার মানতে হয় তাকে। নয়শ কোটি ডলারের সম্পদের মালিক
বার্লুসকোনি মিডিয়া ও ক্রীড়া জগত নিয়েই ছিলেন। কয়েকটি সংবাদপত্র ও
টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানার পাশাপাশি ফুটবল ক্লাব এসি মিলানও তার। ১৯৯৩
সালে রাজনীতিতে নেমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। বলা হয়, তার পত্রিকা ও
টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এ ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর
দায়িত্ব নেওয়ার পরও দুর্নীতি ও নারী কেলেঙ্কারি পিছু ছাড়েনি বার্লুসকোনির।
নিজের রোমের বাড়িকে 'প্রমোদ ভবন' বানিয়ে ব্যাপক সমালোচিতও ছিলেন তিনি।
দুর্নীতি ও যৌন কেলেঙ্কারির চারটি মামলায় নিয়মিত আদালতে হাজিরাও দিতে হচ্ছে
তাকে। এত সবের পর জনপ্রিয়তা কমতে থাকলেও দায়িত্ব থেকে সরে
দাঁড়ানোর কোনো ইচ্ছা দেখা যায়নি বার্লুসকোনির। তবে ব্যাপক দেনা নিয়ে ইতালি
অর্থনীতি ভেঙে পড়লেই বড় বিপাকে পড়েন তিনি। রাজনৈতিক জোটের সঙ্গীরাও তার
সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। ব্যাপক বাজেট ঘাটতির মধ্যে গত
বুধবার ইতালির সরকারের ১০ বছরের বন্ডের সুদের হার সাত শতাংশে পৌঁছায়। এ
সুদের হারের কারণে এর আগে ইউরো জোনের অন্য তিন সদস্য রাষ্ট্র গ্রিস,
আয়ারল্যান্ড ও পর্তুগাল ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে প্রণোদনামূলক ঋণ
সহযোগিতা নিতে বাধ্য হয়। ইউরো জোনের বিপর্যয় এড়াতে ইতালির প্রতি ব্যয় সঙ্কোচনের পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর
আগে মঙ্গলবার বাজেট নিয়ে একটি প্রস্তাবে ভোটাভুটির পর দেখা যায়, দেশ
চালানোর মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা বার্লুসকোনি সরকারের আর নেই। এরপর পদত্যাগের
জন্য তার ওপর চাপ আরো বাড়ে। তখন বার্লুসকোনি ব্যয় সঙ্কোচনের
একটি বিল এনে প্রতিশ্র"তি দেন, পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে তা পাস হলে পদত্যাগ
করবেন তিনি। শনিবার পার্লামেন্টে তা পাস হয়। এরপর তার পদত্যাগ অনিবার্য হয়ে
ওঠে। পাস হওয়া বিলে ২০১৪ সালের মধ্যে বাজেটে আয়-ব্যয়ের
ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে ৫ হাজার ৯৮০ কোটি ইউরো সঞ্চয়ের লক্ষ্যমাত্রা
নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় কমানোর পাশাপাশি কর বাড়ানোরও পরিকল্পনা নেওয়া
হয়েছে। বার্লুসকোনির পদত্যাগের পরপরই নতুন সরকার নিয়ে
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর দল
পিডিএল-এ বিভেদ দেখা দিয়েছে। একটি অংশ নতুন মন্তির নতুন সরকারকে সমর্থন
দেবে বলেও আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও মন্তি সরকারকে সুনজরে
দেখবে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। এদিকে বার্লুসকোনির পদত্যাগের পর
নতুন সরকার ইতালির অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ
করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তার মতো আশা করছেন ফরাসি
প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান ক্রিস্টিনা
লগার্ডও।