অরূপ রাহীবাংলাদেশে সংগীত সম্পর্কিত আলোচনা-বাহাস প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ধ্বনি, অলংকার, কাব্য, গীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তর তর্ক-বাহাস হয়েছে প্রণেতাদের মধ্যে। আধুনিককালে সবচেয়ে বিখ্যাত সংগীতবিষয়ক বাহাস হয়েছে দুই মহাসংগীতজ্ঞ ও শিল্পীর মধ্যে। তাঁরা হলেন শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রী দীলিপকুমার রায়। তাঁদের এ বাহাস রবীন্দ্রনাথের 'সঙ্গীত চিন্তা' গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ঠাকুর-রায় পরবর্তী বাংলা সংগীতজগতে এ রকম সিরিয়াস তর্ক-আলোচনার নজির মেলা ভার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সংগীতের যোগাযোগ সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সংগীতের সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে তুলনীয়। একটা জনগোষ্ঠীর মুক্তিসংগ্রামের ভাষা হিসেবে সংগীতের এমন সামগ্রিক ব্যবহার ও উপস্থিতি দুনিয়ার ইতিহাসে সবার আগে নজরে পড়ার মতো। লিয়ার লেভিনের নেওয়া চিত্র অবলম্বনে নির্মিত 'মুক্তির গান' তথ্যচিত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংগীতের ভূমিকার কিছুটা নজির পাওয়া যায়। আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সংগীতের ভূমিকা নিয়ে যাঁরা জানতে আগ্রহী, তাঁরা লি হার্শ পরিচালিত অনন্য তথ্যচিত্র 'আমান্দলা' (ধসধহফষধ) দেখতে পারেন।
সত্যি কথা বলতে কী, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে সংগীতের উপস্থিতি ব্যাপক ও বিশাল। নিকট-অতীতের ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী সংগ্রামের 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি' থেকে শুরু করে জানা-অজানা শত-সহস্র গানের মাধ্যমে এ সংগ্রাম সাংগীতিক ভাষা পেয়েছে।
সংগীত শুধু সরাসরি বিদ্রোহ, বিপ্লব বা সংগ্রামের প্রকাশমাধ্যম নয়, আমরা জানি। জীবনের নানা অনুভূতি, অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা সংগীতের মাধ্যমে করি। জীবনের নানা রকম অনুভূতি-অভিজ্ঞতা সংগীতের ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার ব্যাপারটা নিজস্ব কোনো আলাদা রাস্তায় বা কৌশলে ঘটে না। অর্থাৎ প্রকাশমাধ্যম ও তার কৌশল জীবনের অভিজ্ঞতা তথা সমাজ-ইতিহাসের, দেশ-কাল-পাত্রোর্ধ্ব কোনো ব্যাপার নয়। শিল্প বা আর্ট তাই দেশ-কাল-পাত্রিক (পড়হঃবীঃঁধষ)। কি ভাব কিভাবে কেন প্রকাশ করতে চাই, তা নিয়ে শিল্পী ও সমাজের একটা দ্বন্দ্ব-মীমাংসা চলে। এ সম্পর্কই নির্ধারণ করে দেয় কোন শিল্প হবে, কিভাবে হবে। পাকিস্তান পর্বে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণবিরোধী আন্দোলন তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা গানের আলোচনায় এসব তত্ত্বকথার কী দরকার_এ প্রশ্ন, জানি, অনেকেই করবেন। তাঁদের জন্য বলি, গান দিয়ে তো সমাজ চেনা যায়। তেমনি সমাজ দিয়েও গান চেনা যায়। গান কেমন? সমাজ যেমন। গান কেমন? সমঝদার যেমন। গান কেমন? সমালোচক যেমন। গান কেমন? শিল্পী যেমন। গান কেমন? সংবাদমাধ্যম যেমন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আজকের বাংলাদেশে বেশির ভাগ উঠতি ও পড়তি গায়ক ও কম্পোজার বলেন, তাঁরা 'ডিফারেন্ট' কিছু করছেন বা করার চেষ্টা করছেন। আমরা কি ভাবি যে এই 'ডিফারেন্ট' কিছু বলতে তাঁরা কী বোঝাতে চান? বিনোদন সাংবাদিকরা কি কখনো ভেবেছেন বা জিজ্ঞেস করেছেন শিল্পীদের যে 'ডিফারেন্ট' ব্যাপারটা কী? শিল্পীরা নিজেরা কী ভেবেছেন? নাকি এসব শব্দ ব্যবহার বিপণন-কৌশলের অংশ? কেউ কেউ এখন বলবেন, ভাই, বাজারের নিয়মেই তো চলতে হবে। যুগ-জামানা বুঝে চলতে হবে না? তাঁদের জন্য এবং আমাদের সবার জন্যই সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকবে_সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে দাস্যবৃত্তি কি শিল্পীর ধর্ম? তাহলে কি 'শিল্পী' ও 'শিল্প' কথাটাও দেশ-কালে পরিবর্তনশীল? কিন্তু দেশ-কালের পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকা নেই? শিল্পীর ভূমিকা নেই? তাহলে স্বাধীনতাসংগ্রাম, মুক্তিসংগ্রাম হয় কী করে? মানবিক কর্তাসত্তা (যঁসধহ ধমবহপু) বলে কি কিছু নেই? ভাববার অবকাশ আছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে নাটক, উপন্যাস বা কবিতা যতটা এগিয়েছে, সংগীত ততটা এগোয়নি। মূলধারার চলচ্চিত্র ও তার সংগীতও এগোয়নি। কথাসাহিত্য, কবিতা বা নাটক নিয়ে আলোচনা, বাহাস পরিমাণে ও গুণে অনেক বেশি হচ্ছে। তার প্রমাণ পাওয়া যাবে এ-সংক্রান্ত প্রকাশনাগুলোতেও। সংগীত নিয়ে তেমনটা একদমই হচ্ছে না। অধিকন্তু দুঃখের খবর হলো, অন্যান্য মাধ্যমের বেশির ভাগ 'সৃজনশীল' মানুষের সংগীতরুচি রক্ষণশীল, গোঁড়া, সেকেলে ও পর্যালোচনাহীন। এর একটা প্রভাব, পরোক্ষ প্রভাব সংগীতের ওপর পড়ে। এমনিতে ধ্রুপদী সংগীতের কথা বাদ দিলে মূলধারার 'আধুনিক' (যার মধ্যে বাংলা পপ, রক, ফিউশন সবই পড়ে) গানের বিবেচনায়, এমনকি 'ব্যান্ড' সংগীত বলে যে সংগীতধারা চালু আছে, তাও এর মধ্যে ধরলে পার্শ্ববর্তী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগোনো বলে যদি কেউ দাবি করে, সে দাবি যথেষ্ট মনোযোগের দাবি রাখে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে। কিন্তু এসব এগোনো-পেছানোর আলোচনাকে আরেক জায়গা থেকে দেখতে হবে। তা হলো, কোন ধারা প্রান্তিক হয়ে গেল, কোন ধারা দাপট দেখাতে শুরু করল। এর সঙ্গে 'সংস্কৃতি-বেসাতি' বা কালচার ইন্ডাস্ট্রির গতি-প্রকৃতি ও প্রভাব খেয়াল করলে তা পরিষ্কার হবে। যেমন বলিউড যেভাবে ভারতের আঞ্চলিক সংগীত রসদ ব্যবহার করে বলিউডিকরণ করছে, তার প্রভাব শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংগীতজগৎকেও প্রভাবিত করছে। একটা দেশের কালচার ইন্ডাস্ট্রির ধরন শুধু সে দেশের পুঁজির বা শাসকশ্রেণীর চরিত্রের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী দশকগুলোতে পশ্চিমা নয়া-উদারীকরণ অর্থনৈতিক নীতিকে সমর্থন জোগাতে নির্বিকার ভোগবাদী সংস্কৃতিকে উৎসাহী করা হয়েছে। তার একটা নজির ডিজুস সংস্কৃতি। পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণের সংস্কৃতি। এটা আগেও ছিল। এখন বেড়েছে। এ কথা ঠিক, আমাদের অনেক 'প্রতিভা' আছে। কিন্তু সেই প্রতিভাকে শিল্পী নিজে এবং অন্যরা কে কিভাবে কাজে লাগাল, সেটাই বড় কথা। কালচার ইন্ডাস্ট্রি তার প্রয়োজনে যেকোনো সংগ্রামী ধারার সাংস্কৃতিক উপাদানকেও দখল, হজম বা আত্তীকরণ করতে দ্বিধা করে না। বাংলাদেশে লোকসংগীত, লালন, হাছন, বাউল-ফকির-সহজিয়া ধারার গানসহ মূলধারার সংগীত ও সংস্কৃতি নিয়ে সেই কাজটিই তারা করছে। আমাদের সংগীত ও সংস্কৃতিজগতের বড় অংশ তাতে দ্বিধাহীন আত্মসমর্পণ করছে। কারণ এ নিয়ে প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক তাকত আমাদের সংগীত ও সংস্কৃতিজগতের বড় অংশেরই হয়নি।
আশা-জাগানিয়া ঘটনা হলো, তরুণদের একটা বড় অংশ সংগীতের এই চাপিয়ে দেওয়া রুচির শাসনের বাইরে আসতে চাইছে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে তা-ই মনে হয়। তারা সংগীত নিয়ে ভাবছে, পর্যালোচনা করছে। তারা নিজেদের পরিচয়ে নিজেরা পরিচিত হতে চায়। তারা বাংলা গান শুনতে চায়। বাংলা গান করতে চায়, গাইতে চায়। তারা সেই সব গান শুনতে চায়, সেই সব সংগীত সৃষ্টি করতে চায়, যা অনেক দেওয়া-নেওয়ার পরও শেষমেশ বাংলা গান হয়ে ওঠে।
যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে, বাজারি সংস্কৃতির যুগে, মেশিন দিয়ে গান গাওয়ার (কারণ কণ্ঠ দিয়ে গাওয়ার ক্ষমতা নেই, তবু 'তারকা' হতে হবে), 'হিট' আইটেম বানানোর এ যুগে নতুন প্রজন্মের এ 'বাংলা গান' করতে চাওয়া এবং শুনতে চাওয়ার ঘটনা আমার কাছে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের বাংলা গানের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময় ঘটনা মনে হয়। এটাই সম্ভবত সংগীতক্ষেত্রে এ সময়ের স্বাধীনতার চেতনার প্রকাশ।
লেখক : কবি, সঙ্গীতজ্ঞ (সূত্র: কালের কন্ঠ) লিংক:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সংগীতের যোগাযোগ সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সংগীতের সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে তুলনীয়। একটা জনগোষ্ঠীর মুক্তিসংগ্রামের ভাষা হিসেবে সংগীতের এমন সামগ্রিক ব্যবহার ও উপস্থিতি দুনিয়ার ইতিহাসে সবার আগে নজরে পড়ার মতো। লিয়ার লেভিনের নেওয়া চিত্র অবলম্বনে নির্মিত 'মুক্তির গান' তথ্যচিত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংগীতের ভূমিকার কিছুটা নজির পাওয়া যায়। আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সংগীতের ভূমিকা নিয়ে যাঁরা জানতে আগ্রহী, তাঁরা লি হার্শ পরিচালিত অনন্য তথ্যচিত্র 'আমান্দলা' (ধসধহফষধ) দেখতে পারেন।
সত্যি কথা বলতে কী, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে সংগীতের উপস্থিতি ব্যাপক ও বিশাল। নিকট-অতীতের ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী সংগ্রামের 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি' থেকে শুরু করে জানা-অজানা শত-সহস্র গানের মাধ্যমে এ সংগ্রাম সাংগীতিক ভাষা পেয়েছে।
সংগীত শুধু সরাসরি বিদ্রোহ, বিপ্লব বা সংগ্রামের প্রকাশমাধ্যম নয়, আমরা জানি। জীবনের নানা অনুভূতি, অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা সংগীতের মাধ্যমে করি। জীবনের নানা রকম অনুভূতি-অভিজ্ঞতা সংগীতের ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার ব্যাপারটা নিজস্ব কোনো আলাদা রাস্তায় বা কৌশলে ঘটে না। অর্থাৎ প্রকাশমাধ্যম ও তার কৌশল জীবনের অভিজ্ঞতা তথা সমাজ-ইতিহাসের, দেশ-কাল-পাত্রোর্ধ্ব কোনো ব্যাপার নয়। শিল্প বা আর্ট তাই দেশ-কাল-পাত্রিক (পড়হঃবীঃঁধষ)। কি ভাব কিভাবে কেন প্রকাশ করতে চাই, তা নিয়ে শিল্পী ও সমাজের একটা দ্বন্দ্ব-মীমাংসা চলে। এ সম্পর্কই নির্ধারণ করে দেয় কোন শিল্প হবে, কিভাবে হবে। পাকিস্তান পর্বে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণবিরোধী আন্দোলন তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা গানের আলোচনায় এসব তত্ত্বকথার কী দরকার_এ প্রশ্ন, জানি, অনেকেই করবেন। তাঁদের জন্য বলি, গান দিয়ে তো সমাজ চেনা যায়। তেমনি সমাজ দিয়েও গান চেনা যায়। গান কেমন? সমাজ যেমন। গান কেমন? সমঝদার যেমন। গান কেমন? সমালোচক যেমন। গান কেমন? শিল্পী যেমন। গান কেমন? সংবাদমাধ্যম যেমন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আজকের বাংলাদেশে বেশির ভাগ উঠতি ও পড়তি গায়ক ও কম্পোজার বলেন, তাঁরা 'ডিফারেন্ট' কিছু করছেন বা করার চেষ্টা করছেন। আমরা কি ভাবি যে এই 'ডিফারেন্ট' কিছু বলতে তাঁরা কী বোঝাতে চান? বিনোদন সাংবাদিকরা কি কখনো ভেবেছেন বা জিজ্ঞেস করেছেন শিল্পীদের যে 'ডিফারেন্ট' ব্যাপারটা কী? শিল্পীরা নিজেরা কী ভেবেছেন? নাকি এসব শব্দ ব্যবহার বিপণন-কৌশলের অংশ? কেউ কেউ এখন বলবেন, ভাই, বাজারের নিয়মেই তো চলতে হবে। যুগ-জামানা বুঝে চলতে হবে না? তাঁদের জন্য এবং আমাদের সবার জন্যই সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকবে_সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে দাস্যবৃত্তি কি শিল্পীর ধর্ম? তাহলে কি 'শিল্পী' ও 'শিল্প' কথাটাও দেশ-কালে পরিবর্তনশীল? কিন্তু দেশ-কালের পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকা নেই? শিল্পীর ভূমিকা নেই? তাহলে স্বাধীনতাসংগ্রাম, মুক্তিসংগ্রাম হয় কী করে? মানবিক কর্তাসত্তা (যঁসধহ ধমবহপু) বলে কি কিছু নেই? ভাববার অবকাশ আছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে নাটক, উপন্যাস বা কবিতা যতটা এগিয়েছে, সংগীত ততটা এগোয়নি। মূলধারার চলচ্চিত্র ও তার সংগীতও এগোয়নি। কথাসাহিত্য, কবিতা বা নাটক নিয়ে আলোচনা, বাহাস পরিমাণে ও গুণে অনেক বেশি হচ্ছে। তার প্রমাণ পাওয়া যাবে এ-সংক্রান্ত প্রকাশনাগুলোতেও। সংগীত নিয়ে তেমনটা একদমই হচ্ছে না। অধিকন্তু দুঃখের খবর হলো, অন্যান্য মাধ্যমের বেশির ভাগ 'সৃজনশীল' মানুষের সংগীতরুচি রক্ষণশীল, গোঁড়া, সেকেলে ও পর্যালোচনাহীন। এর একটা প্রভাব, পরোক্ষ প্রভাব সংগীতের ওপর পড়ে। এমনিতে ধ্রুপদী সংগীতের কথা বাদ দিলে মূলধারার 'আধুনিক' (যার মধ্যে বাংলা পপ, রক, ফিউশন সবই পড়ে) গানের বিবেচনায়, এমনকি 'ব্যান্ড' সংগীত বলে যে সংগীতধারা চালু আছে, তাও এর মধ্যে ধরলে পার্শ্ববর্তী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগোনো বলে যদি কেউ দাবি করে, সে দাবি যথেষ্ট মনোযোগের দাবি রাখে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে। কিন্তু এসব এগোনো-পেছানোর আলোচনাকে আরেক জায়গা থেকে দেখতে হবে। তা হলো, কোন ধারা প্রান্তিক হয়ে গেল, কোন ধারা দাপট দেখাতে শুরু করল। এর সঙ্গে 'সংস্কৃতি-বেসাতি' বা কালচার ইন্ডাস্ট্রির গতি-প্রকৃতি ও প্রভাব খেয়াল করলে তা পরিষ্কার হবে। যেমন বলিউড যেভাবে ভারতের আঞ্চলিক সংগীত রসদ ব্যবহার করে বলিউডিকরণ করছে, তার প্রভাব শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংগীতজগৎকেও প্রভাবিত করছে। একটা দেশের কালচার ইন্ডাস্ট্রির ধরন শুধু সে দেশের পুঁজির বা শাসকশ্রেণীর চরিত্রের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী দশকগুলোতে পশ্চিমা নয়া-উদারীকরণ অর্থনৈতিক নীতিকে সমর্থন জোগাতে নির্বিকার ভোগবাদী সংস্কৃতিকে উৎসাহী করা হয়েছে। তার একটা নজির ডিজুস সংস্কৃতি। পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণের সংস্কৃতি। এটা আগেও ছিল। এখন বেড়েছে। এ কথা ঠিক, আমাদের অনেক 'প্রতিভা' আছে। কিন্তু সেই প্রতিভাকে শিল্পী নিজে এবং অন্যরা কে কিভাবে কাজে লাগাল, সেটাই বড় কথা। কালচার ইন্ডাস্ট্রি তার প্রয়োজনে যেকোনো সংগ্রামী ধারার সাংস্কৃতিক উপাদানকেও দখল, হজম বা আত্তীকরণ করতে দ্বিধা করে না। বাংলাদেশে লোকসংগীত, লালন, হাছন, বাউল-ফকির-সহজিয়া ধারার গানসহ মূলধারার সংগীত ও সংস্কৃতি নিয়ে সেই কাজটিই তারা করছে। আমাদের সংগীত ও সংস্কৃতিজগতের বড় অংশ তাতে দ্বিধাহীন আত্মসমর্পণ করছে। কারণ এ নিয়ে প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক তাকত আমাদের সংগীত ও সংস্কৃতিজগতের বড় অংশেরই হয়নি।
আশা-জাগানিয়া ঘটনা হলো, তরুণদের একটা বড় অংশ সংগীতের এই চাপিয়ে দেওয়া রুচির শাসনের বাইরে আসতে চাইছে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে তা-ই মনে হয়। তারা সংগীত নিয়ে ভাবছে, পর্যালোচনা করছে। তারা নিজেদের পরিচয়ে নিজেরা পরিচিত হতে চায়। তারা বাংলা গান শুনতে চায়। বাংলা গান করতে চায়, গাইতে চায়। তারা সেই সব গান শুনতে চায়, সেই সব সংগীত সৃষ্টি করতে চায়, যা অনেক দেওয়া-নেওয়ার পরও শেষমেশ বাংলা গান হয়ে ওঠে।
যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে, বাজারি সংস্কৃতির যুগে, মেশিন দিয়ে গান গাওয়ার (কারণ কণ্ঠ দিয়ে গাওয়ার ক্ষমতা নেই, তবু 'তারকা' হতে হবে), 'হিট' আইটেম বানানোর এ যুগে নতুন প্রজন্মের এ 'বাংলা গান' করতে চাওয়া এবং শুনতে চাওয়ার ঘটনা আমার কাছে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের বাংলা গানের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময় ঘটনা মনে হয়। এটাই সম্ভবত সংগীতক্ষেত্রে এ সময়ের স্বাধীনতার চেতনার প্রকাশ।
লেখক : কবি, সঙ্গীতজ্ঞ (সূত্র: কালের কন্ঠ) লিংক: