৮ এপ্রিল, ২০১১

‘ক্রসফায়ার’ ও ‘মানবাধিকার’ : আমরা আর কতকাল মিনতি জানাতে থাকব?

অরূপ রাহী   

সেকি অন্য তত্ত্ব মানে/মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে -লালন ফকির,  

‘একজন ‘ক্রিমিনাল’ হলো এমন একজন লোক, যার করপোরেশন গড়ার সব গুণই আছে, শুধু পুঁজি নাই’ -ক্ল্যারেন্স ড্যারো


১.

‘‘দেশে কোনো ‘ক্রসফায়ার’ হচ্ছে না।’’

কথা ঠিক। বাংলাদেশে দৃশ্যমান, আমলযোগ্য কোনো ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ শক্তি বা বাহিনী নেই, যারা বর্তমান রাষ্ট্রের বাহিনীর বিপক্ষে লড়তে চায় বা পারে। ফলে ‘ক্রসফায়ার’ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। ‘ক্রসফায়ার’ হতে দুটি পক্ষ লাগে। এখানে পক্ষ একটাই।

‘ক্রসফায়ার’ সিস্টেমের অংশ। কথা ঠিক। ক্রসফায়ার এই রাষ্ট্র-সিস্টেমের অংশ। রেডি আছে। যখন দরকার ব্যবহার করা হয়। সিস্টেমে আরো আছে : গুম, ভাগবাটোয়ারা, চাঁদাবাজি, ঘুষ, নানারকম নিপীড়ন-নির্যাতন ইত্যাদি। 
‘দেশে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটছে না’

এ কথাও ঠিক। ‘ক্রসফায়ার’ও একরকম বিচার। রাস্তার গণপিটুনিতে ছিনতাইকারী বা ছিঁচকে চোরের মৃত্যুতে হাততালি দিয়ে একধরনের বিচার অনুষ্ঠান করি আমরা। ক্রসফায়ার-বিচারের উৎপত্তি সেখান থেকেই। সমাজ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির রমরমা। রাষ্ট্র তো বগল বাজাবেই।

২.

কিন্তু কথা অন্যদিকেও আছে। ‘ক্রসফায়ার’ ক্রসফায়ার নয়। ফায়ার। রাষ্ট্র/শাসকগোষ্ঠী গুলি ছুড়ছে, ‘অপরাধী’ (আপদ) বিদায় করতে। এই আপদের তালিকায় আছে : ব্যক্তিগত ‘শত্রু’ (সাধারণ মানুষ, উঠতি ‘সন্ত্রাসী’, ছোট/মাঝারি রাজনৈতিক নেতা/ব্যবসায়ী); এবং রাষ্ট্রীয়/সামাজিক ‘শত্রু’ (ইসলামী/কমিউনিস্ট চরমপন্থী); গুরুতর অপরাধের নিরীহ/অনিরীহ সাক্ষী, এরকম আরো অনেকে। ‘শত্রু’/‘অপরাধী’/আপদ নির্ধারণের আপাত কোনো সাধারণ নিয়ম নেই। কিন্তু ‘শত্রুর’ ধরন-ধারণ দেখে নিয়মটা সহজেই বের করা যায়। সমাজ-রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এই তালিকায় পড়েন না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য ক্রসফায়ারে কেউ মারা পড়ে না, ভূমিদস্যুতার জন্যও না। পরিবেশ দূষণের জন্যও না। ঋণখেলাপির জন্যও না। সুদের কারবারির জন্যও না।  ভেজাল-খাদ্য ব্যবসার জন্যও না। শ্রমশোষণ-উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণের জন্যও না। দেশের সম্পদ বহুজাতিকের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যও না। সমাজ-রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এই তালিকায় না পড়ার সঙ্গত কারণ আছে। ‘অপরাধ’ এবং ‘বিচারে’র আইন তারাই তৈরি করেন। তাদের ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’-ই আজকের শাসনব্যবস্থা।

৩.

বোনাপার্ট-৩-এর প্রাইভেট আর্মি হিসেবে কুখ্যাত ‘সোসাইটি অব ডিসেম্বর টেন’ যাদের নিয়ে গঠিত, সেই ‘বোহেমিয়ান’দের একটা অংশই আজকের ক্রসফায়ারের শিকার। আজকের বোহেমিয়ান, যারা ক্রসফায়ারে পড়ছেন, তাদের মধ্যে আছে : খ্যাপাটে কবি, অফশুট/বেমানান বুর্জোয়া, ছিঁচকে চোর, রাস্তার ছিনতাইকারী, খ্যাপাটে বিপ্লবী, ইত্যাদি। নিরীহ আমজনতা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- এরা কীভাবে এই তালিকায় ঢুকে যায়? কারণ আমাদের সমাজ, আমাদের বাহিনী, আমাদের রাষ্ট্র বুর্জোয়া মানবাধিকার চর্চার সক্ষমতা অর্জন করেনি। ‘উন্নত’ বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলো তার নিজের টিকে থাকার ন্যায্যতা বজায় রাখতে নাগরিকদের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করতে বাধ্য হয় সমাজে এক ধরনের গণতন্ত্রায়নে। কিন্তু ওইসব রাষ্ট্রও বেকায়দায় পড়ে, যখন উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম হাজির হয়, যখন শ্রমশোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিক জেগে ওঠে, যখন বুর্জোয়া ‘সিভিলিটি’র ধার ধারে না কোনো ‘অফশুট’, তখন রাষ্ট্র তার আদিম, বর্বর চেহারায় হাজির হয়। রাষ্ট্র যেন ভুলে না যায়, আমরা যেন ভুলে না যাই, সিভিলিটি একটা বিশেষ আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার বিশেষ মানবিক প্রকাশ। এই প্রকাশের শর্ত পূরণ না করলে কেউই ‘মানবিক’ থাকে না, থাকতে পারে না। পশ্চিমে (পুঁজিবাদ ও বড়লোকের গণতন্ত্র) উদ্ভূত ‘মানবাধিকার’ তত্ত্বের মূল সমস্যা/সীমাবদ্ধতা এখানেই। যে ব্যবস্থা মানুষের (নারী-শিশু-পুরুষ-শ্রমিক-ভিন্ন সংস্কৃতি নির্বিশেষে) মর্যাদাপূর্ণ বাঁচার শর্তপূরণ করে না, সেই ব্যবস্থা ‘মানবাধিকার’ সংকটের মুখোমুখি হবেই। তার নিজস্ব নৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক দাবিদার অনেক রাষ্ট্রের ‘মানবাধিকার’ সংকটেও পশ্চিমা মানবাধিকার ধ্বজাধারীদের উল্লেখ করার মতো কোনো অর্জন নেই। এই সংকটের সমাধান পুঁজিবাদী-বড়লোকী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে উদ্ভূত ‘মানবাধিকার’ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সম্ভব হয় না, হবে না। যে কারণে আমরা শত শত মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ শুনতে পাই, বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যানের মিনতি শুনতে পাই, কিন্তু না বাংলাদেশ রাষ্ট্র, না দুনিয়ার অন্য কেনো রাষ্ট্র ‘মানবিক’ হয়ে উঠছে। ‘মানবিক’ রাষ্ট্র কি অসম্ভব? জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা’য় যা যা বলা আছে, তার কোনোটাই  পুঁজিবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না। এই ঘোষণায় শ্রমশোষণকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মনে করা হয় না। ন্যায্য মজুরির কথা বলা হয়, কিন্তু ন্যায্য মজুরির মতো ভোগ-ভুয়া আইডিয়া আর হয় না। এটা কত ভুয়া আইডিয়া, তা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন কাঠামোর দিকে তাকালেই চলে। দুনিয়ায় এখনো শ্রমদাসত্ব চলছে। ‘মানবাধিকার’ সংগঠনগুলো এখনো করপোরেটবান্ধব ‘ন্যায্য মজুরি’ তত্ত্বেই আস্থা রেখেছে। পশ্চিমা মানবাধিকার তত্ত্বের কি সেই সীমাবদ্ধতা? প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো এই ঘোষণা সার্বজনীনতার কথা বলে। কিন্তু বিশেষ স্থান-কাল-সংস্কৃতির মানুষের ক্ষেত্রে এই ‘সার্বজনীনতা’ কীভাবে কাজ করবে, তা স্পষ্ট না। আমরা খেয়াল করলে দেখব, ঘোষণায় ‘সার্বজনীনতার’ কথা বলা হয়। কিন্তু তা বড়লোকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড়লোকদের জন্য তো নয়ই। তারা আলাদা। বিশেষ। গরিবরা মানবাধিকার চাইবে। বড়লোকরা দেবে। এটা দাতা-গ্রহীতা সম্পর্ক। কারণ রাষ্ট্র বড়লোকের। বড়লোকরাই রাষ্ট্র। বড়লোকরা, বহুজাতিক করপোরেশনরা বরং, এই ছদ্ম সার্বজনীনতা রাষ্ট্র এবং তার মালিকশ্রেণীর, বহুজাতিক করপোরেশনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নানান কায়দা-কৌশলে ব্যবহৃত হয়। গুয়ানতানামো-বের খবর আমরা জানি।  ‘মানবাধিকার’ লঙ্ঘনের দায়ে কেউ কি এখনো পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার করতে পেরেছে? ব্যক্তি মালিকানাভিত্তিক নাগরিক গণতন্ত্র এথেন্স হয়ে রোমান সাম্রাজ্য হয়ে ‘আধুনিক’ ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছে। এথেনীয়… গণতন্ত্রে বড়লোক নাগরিকরা নিজেরাই শাসক, নিজেরাই শাসিত ছিলেন। পুঁজিবাদের বিকাশের এ পর্যায়ে আধুনিক রাষ্ট্র নিজের ভাষায় নাগরিকত্বের সীমানা বৃদ্ধি করে তা ‘মানুষ’ পর্যন্ত পৌঁছানোর ঘোষণা দেয়। দাসবিদ্রোহ, উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন, নারী আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন ইত্যাদি- তাদের এই ঘোষণা দিতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ‘মানুষ’-এর সংজ্ঞাই তো নির্ধারিত নয়। ‘আধুনিক মানুষ’-এর যে ছবি দুনিয়ায় প্রভাবশালী, সে তো একজন ‘পশ্চিমা সিভিল বুর্জোয়া’। যে আত্মরক্ষার নামে আগ্রাসন করে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। এই ‘আধুনিক’ মানুষের বাইরের গণমানুষ আছে। পশ্চিমেও, পূর্বেও।

৪.

সমাজ থেকে ‘সন্ত্রাস’ দূর করার জন্য ‘ক্রসফায়ার’/‘এনকাউন্টার’/‘বন্দুকযুদ্ধ’ করা হচ্ছে। সমাজে ‘সন্ত্রাস’ দূর করতে রাষ্ট্র সন্ত্রাস করছে। রাষ্ট্রের এই সন্ত্রাস কি ন্যায্য? রাষ্ট্রের এই সন্ত্রাস চলতে থাকলে কি সমাজ থেকে ‘সন্ত্রাস’ দূর হবে? অসম্ভব। বড়লোকের রাষ্ট্র নিজেই একটা সন্ত্রাসী ব্যবস্থা। উদ্বৃত্তশ্রম শোষণের ব্যবস্থা জারি রাখতে রাষ্ট্রের বাহিনী/মেশিনারিজ ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রের বাহিনীর সঙ্গে গণমানুষের দূরত্ব ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র শ্রমিক মারে, আদিবাসী মারে, কৃষক মারে। বড়লোকরা নিজেরা নিজেরা চেষ্টা করে আপস-মীমাংসা করে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ম্যানেজ করতে। যখন তা আর সম্ভব হয় না, তখন যদি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক শক্তি সমাজে হাজির না থাকে, তখন সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা হাতে নেয়। তখন এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। একচেটিয়া হয়। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শক্তি জোরদার নয়। বাংলাদেশে তাই রাষ্ট্রের একচেটিয়া সন্ত্রাস। রাষ্ট্রের এই নিরঙ্কুশ সন্ত্রাসের বাইরে আর কোনো সন্ত্রাসকে বুর্জোয়া রাষ্ট্র নিজের জন্য হুমকি মনে করে। তার কর্তৃত্ব সংকটে পড়ে। তাই সে তার মতো করে বিচার ও অবিচার ব্যবস্থা সাজায়। আদালতও চলে; গুম, ক্রসফায়ারও চলে। এটা করতে গিয়ে রাষ্ট্র, এমনকি সবচেয়ে ‘উদার’ রাষ্ট্রও নিজের এবং সমাজে ‘সন্ত্রাসের’ কারণ, উৎস ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে একচোখা হয়ে পড়ে। যে কারণে সে একই ক্রসফায়ারে বড়লোক বাদে আর সবাইকে ফেলতে পারে। তা সে খ্যাপাটে কবি, অফশুট/বেমানান বুর্জোয়া, ছিঁচকে চোর, রাস্তার ছিনতাইকারী, খ্যাপাটে বিপ্লবী (ইসলামী/কমিউনিস্ট), যেই হোক। আর রাষ্ট্রের হাত অনেক লম্বা হলেও হাতের শেষ অংশ অনেক সময়ই মাথার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় ব্যক্তির স্বার্থচরিতার্থ করার চর্চা তো আর নতুন না। এই ‘ব্যবস্থার’ মধ্যে আমজনতা, নিরীহ ছাত্র গুম হওয়া, ক্রসফায়ারে পড়া অসম্ভব কিছু না।  তাতে রাষ্ট্রের কিছু আসে যায় না।

‘ক্রসফায়ার’/‘এনকাউন্টার’/‘বন্দুকযুদ্ধ’ দিয়ে  ‘সন্ত্রাসের’ কিছু লক্ষণ দূর হয়,  কারণগুলো নয়, ফলে ‘সন্ত্রাস’ চলতেই থাকে, ‘সন্ত্রাসী’ পয়দা হতেই থাকে। অন্যায়-সন্ত্রাসভিত্তিক রাষ্ট্র-সমাজই নানারকম ‘সন্ত্রাসে’র জন্মদাতা। আদিম সঞ্চয়ন থেকে আজকের করপোরেট পুঁজির বিশ্ববিস্তার। এই যাত্রাপথে গড়ে ওঠা এই রাষ্ট্রই, এই সমাজই, প্রতিমুহূর্তে ‘সন্ত্রাসী’ জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াই চলছে ‘সভ্যতায়’। কেন কেউ একজন সন্ত্রাসী হয়? কেন কেউ একজন চুরি করে, পকেটমার হয়? কেন কেউ একজন ‘সন্ত্রাসবাদী’ হয়? ‘চরমপন্থী’ হয়? কেন কেউ আত্মঘাতী ‘বিপ্লবী’ হয়- এসব প্রশ্নের মুখোমুখি কি এই রাষ্ট্র-সমাজ সৎভাবে হওয়ার চেষ্টা করেছে? আমরা তা মনে করি না। সময় এসেছে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার। রাষ্ট্র এসব ‘শত্রু’/‘অপরাধী’র সঠিক জবানবন্দিও কেন আদালতের মাধ্যমে নাগরিকদের জানতে দেয় না? নাগরিকরা কেন জানতে চায় না এসব প্রশ্নের উত্তর? এসবই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র-সমাজের লক্ষণ।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সিরাজ সিকদারকে হত্যার মাধ্যমে যে ফ্যাসিস্ট খুনের শাসনের নতুন পর্ব শুরু হয়েছে, তার ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যা, রাষ্ট্রের বাহিনীর হাতে নিপীড়ন-হত্যার প্রক্রিয়া আরো গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে। আওয়ামী-বিএনপি-জামায়াত-জাপা এসব ফ্যাসিস্ট শক্তি, শাসকশ্রেণীর এই ধারা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।

‘বিশৃঙ্খলা’, ‘পাগলামি’, ‘সন্ত্রাস’ ইত্যাদির প্রচলিত, প্রভাবশালী সংজ্ঞা তো পুঁজিবাদের সাপেক্ষে তৈরি। যা কিছু পুঁজিবাদ ও ‘বড়লোকের গণতান্ত্রিক’ পরিবেশে ‘উপদ্রব’, তাই ‘বিশৃঙ্খলা’, ‘পাগলামি’, ‘সন্ত্রাস’। আনসিভিল। তাকে শেষ করে দাও। জেলে পুরো। পাগলা গারদে পাঠাও। ভালো হয় যদি মেরে ফেলতে পার। গুম করে ফেলতে পারলে আরো ভালো। তখন আর ‘নাগরিক’ অধিকারের প্রশ্ন নেই। আর ‘সিভিল’ উপদ্রবকে কিনে নাও, হজম করে ফেল।

৫.

‘মানুষ’ কে? ‘মানুষ’ কোথায়? ‘মানব’ কারে বলে? মানুষ, মানবতা কোনো চিরায়ত সত্তা নয়। এটা একটা স্বনির্মাণ প্রক্রিয়া। মানুষের শ্রেণী-লিঙ্গ-বয়স-সংস্কৃতি পরিচয় আছে। শ্রেণীবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, বয়সবাদীতা, বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ- একেকটি পর্দা, একেকটি ভেদমূলক ব্যবস্থা, যা মানুষের মর্যাদার লঙ্ঘন করছে। সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার অন্যতম একটা কথা : নারীর অধিকারও মানবাধিকার। এই বক্তব্য পুরুষতন্ত্রের নিশানা আছে। এই বক্তব্য আমাদের জানান দিয়ে রাখে- পুরুষ আগেই অধিকার পেয়ে গেছে। অন্য লিঙ্গের অধিকার না পেলে পুরুষের অধিকার আদৌ আসবে কিনা সে প্রশ্ন উহ্যই থেকে যায়। লাতিন আমেরিকার জনগণ মা-পৃথিবীর (mother earth) অধিকারের প্রশ্ন তুলেছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে নিয়ন্ত্রণমূলক সম্পর্ক, তাও তো অন্যের অধিকার খর্ব করে, অন্যকে বঞ্চিত করে। ‘মানবাধিকার’কে এসব প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হবে। বিভেদের কারণ বজায় রেখে সার্বজনীন ‘মানুষ’, সার্বজনীন ‘মানবতা’ ও তার ‘অধিকার’ খোঁজা অবান্তর।

প্রচলিত ‘মানবাধিকার’ চিন্তা ও চর্চা রাষ্ট্র-করপোরেট শক্তির একচেটিয়া সন্ত্রাসী ক্ষমতার প্রয়োগ থেকে ‘নাগরিক’/সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্র ‘মানবাধিকার’কে ক্রসফায়ারে ফেলেছে। রাষ্ট্র এই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে সংবেদনশীল ‘মানুষ’দের প্রতি। নাগরিক হিসেবে আমরা ‘মানবাধিকার’ সংগঠনগুলোকে তাদের  ‘মানব’ ও ‘অধিকারের’ সংজ্ঞা পর্যালোচনার আহবান জানাই। ‘মানবাধিকারের’ পশ্চিমা, পুঁজিবাদী-পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও চর্চা থেকে বের হয়ে এসে, মিনতি ও  অনুযোগের চেয়ে কার্যকর কোনো ভাষা ও কৌশল তাদের বের করতেই হবে।

তাহলে কি আমরা ‘ক্রসফায়ার’ এবং আরো বিভিন্ন উপায়ে ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যার বিচার চাইব না? অবশ্যই চাইব। চলতি রাষ্ট্রব্যবস্থা, তার সংবিধান যে বিচার ব্যবস্থা তৈরি করেছে, নাগরিক হিসেবে আমরা সেখানে বিচার চাইতে অবশ্যই যাব। গিয়েছিও আমরা অনেকে। আমরা দেখেছি আদালতের রায় এবং উপদেশ এই রাষ্ট্র থোড়াই কেয়ার করে চলেছে। শাসকশ্রেণী জনগণের কাছে যে ন্যূনতম মানবিক অধিকারের অঙ্গীকার ভোটের খাতিরে, টিকে থাকার খাতিরে করে, সেটুকুও বাস্তবায়ন করে না। বারবার তার অসংখ্য উদাহরণ তৈরি করে চলেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটা শাসন ব্যবস্থায় ‘ন্যায়বিচার’ নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন নির্ভর করে শাসকশ্রেণী ন্যায়বিচার বলতে কি বোঝে এবং কি বুঝতে চায়, তার ওপর। উদাহরণ : অধিকাংশ দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে, দু-একটি দেশে নেই। কোনো দেশে চুরির দন্ড জেল, কোনো দেশে হাত কেটে ফেলা। সার্বজনীন ন্যায়বিচার, সার্বজনীন মানবাধিকারের মতোই একটি বিমূর্ত ধারণামাত্র। একে কোনো একটা ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার সাপেক্ষেই নির্মাণ করার, বিকশিত করার প্রশ্ন তাই সামনে এসে পড়ে। আমদানিকৃত, পশ্চিমা (পুঁজিবাদী-বড়লোকী গণতান্ত্রিক) ‘সুশাসনে’র বটিকা দিয়ে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। এই আমদানি করা ‘সুশাসন’ করপোরেট পুঁজির সেবক। গরিবের ভোটে বড়লোকের শাসন স্থায়ী করার তরিকা। মোটেই গণতান্ত্রিক কিছু নয়। মানবাধিকারের গণতান্ত্রিকচর্চা ও প্রয়োগের ঐতিহাসিক কোনো শর্তই বাংলাদেশ পূরণ করে না। কারণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যথেষ্ট গণতান্ত্রিক নয়। ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক শাসন, গণমানুষের মানবিক অধিকারের ধারণার ব্যাপক পর্যালোচনা, পরিবর্তন এবং সে সাপেক্ষে সমাজ ও রাষ্ট্রের অব্যাহত গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই কেবল একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নমুক্ত দেশ ও দুনিয়া গড়ে তোলা সম্ভব।

আমরা যদি ‘বদ্ধজীব’ দশা থেকে ‘রাজনৈতিক প্রাণী’ হয়ে উঠতে না পারি, রাষ্ট্র ও সমাজের পরিসরে মানুষ হিসেবে আমাদের যে তুলনামূলক সার্বভৌমত্ব আছে, আমাদের ন্যায্যতার বোধ থেকে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে তার চর্চা যদি না করি, সমাজকে যদি আমরা ন্যায়ভিত্তিক করার বদলে নিজেরা কেবলই এই অন্যায় সমাজের জানের ছদকায় পরিণত হই, তাহলে ব্যাপক অর্থে একটা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ আশা করা বাতুলতা। ইতিহাসের এই পর্বে তাই প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মানুষ হওয়ার, গণতান্ত্রিক মানুষ তৈরি হওয়ার বাতাবরণ সৃষ্টির সাধনা করা। শ্রম-শোষণভিত্তিক ব্যক্তিমালিকানার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা  পুরুষতান্ত্রিক-পুঁজিতান্ত্রিক মানবতার সংস্কার দূর করা। সেটাই হবে মানবতার নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ।



অরূপ রাহী : কবি, লেখক ও সঙ্গীতশিল্পী। দলনেতা, গানের দল লীলা
প্রকাশিত : সাপ্তাহিক বুধবার, ১৭ মার্চ-১১। লিংক: http://budhbar.com/?p=4631