নিবন্ধ




 প্রযুক্তিগুরু স্টিভ জবস এর কিছু একান্ত কথা
স্টিভ জবস ১৯৭৬ সালের দিকে বন্ধু স্টিভ উজনেককে নিয়ে ‘অ্যাপল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। তিনি তথ্যপ্রযুক্তি জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দেন পারসোনাল কম্পিউটার বা পিসি ধারণা প্রতিষ্ঠা করে। এর আগে সাধারণ মানুষের কম্পিউটার বিষয়ে খুব স্বচ্ছ ধারণাও ছিল না। কিন্তু স্টিভ জবসের পিসি মানুষের ধারণাকেই পাল্টে দেয়। এই কম্পিউটারের নাম তিনি দেন ‘অ্যাপল’। মূলত এর পরই সাধারণের কাছে পৌঁছতে থাকে কম্পিউটার। গড়ে ওঠে অনেক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান।  কিন্তু দুঃখজনকভাবে স্টিভ জবস ১৯৮৫ সালের দিকে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহীর পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তবে ভেঙে না পড়ে পরে তিনি অ্যানিমেশন স্টুডিও পিক্সার প্রতিষ্ঠা করেন। তবে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্টিভ এখনো তথ্যপ্রযুক্তি জগতে নায়ক হিসেবেই আছেন। ২০০৫ সালের ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তা হিসেবে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন স্টিভ জবস। সেটি এখনও বহু তরুণকে উজ্জীবিত করে।  দীর্ঘ সেই ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ পাঠকদের জন্য। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আসতে পেরে আমি খুবই সম্মানিত বোধ করছি। আমি কখনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করিনি। সত্যি কথা বলতে, আজকেই আমি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান সবচেয়ে কাছ থেকে দেখছি। রিড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার ছয় মাসের মধ্যেই আমি পড়ালেখা ছেড়ে দিই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার আগে প্রায় বছর দেড়েক কিছু কোর্স নিয়ে কোনোমতে লেগেছিলাম। কেন আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছিলাম? আমার বয়স যখন ১৭ বছর, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু আমি বোকার মতো স্ট্যানফোর্ডের সমান খরুচে একটি বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিয়েছিলাম। আর আমার নিম্নমধ্যবিত্ত বাবা-মার সব জমানো টাকা আমার পড়ালেখার পেছনে চলে যাচ্ছিলো। ছয় মাস যাওয়ার পর আমি এর কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। জীবনে কী করতে চাই সে ব্যাপারে আমার তখনও কোনো ধারণা ছিল না। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া কীভাবে আমাকে সাহায্য করবে সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। অথচ বাবা-মা তাদের সারা জীবনের সঞ্চয় আমার পড়ার পেছনে ব্যয় করে চলেছেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং আশা করলাম, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই সময়ে এটা ভয়াবহ সিদ্ধান্ত মনে হতে পারে, কিন্তু এখন পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় এটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত। যখনই আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলাম, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই ডিগ্রির জন্য আমার অপছন্দের কোর্সগুলোও বন্ধ করে দিলাম। ২. আমি খুব সৌভাগ্যবান। জীবনের প্রথমেই আমি আমার ভালোবাসার কাজ খুঁজে পেয়েছি। বন্ধু উজনেককে নিয়ে যখন আমার বাবা-মার গ্যারাজে অ্যাপল কোম্পানি শুরু করি, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। আমরা কঠিন পরিশ্রম করেছি। মাত্র ১০ বছরে অ্যাপল গ্যারাজের দুজনের কোম্পানি থেকে ৪ হাজার কর্মীর ২ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়। আমার বয়স তখন ৩০। এর অল্প কিছুদিন আগে আমরা আমাদের সেরা কম্পিউটার ‘ম্যাকিন্টোশ’ বাজারে নিয়ে আসি। আর ঠিক তখনই আমার চাকরি চলে যায়। কীভাবে একজন তার নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থেকে চাকরিচ্যুত হয়?  অ্যাপল যখন অনেক বড়ো হতে লাগল তখন আমরা প্রতিষ্ঠানটি খুব ভালোভাবে চালাতে পারবেন এমন একজনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবলাম। নিয়োগ দেয়াও হলো। প্রথম বছর সবকিছু ভালো যাচ্ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার সাথে আমার চিন্তাভাবনার বিভাজন স্পষ্ট হওয়া শুরু হলো। আর পরিচালনা পর্ষদ তার পক্ষ নিলো। ফলাফল, ৩০ বছর বয়সে আমাকে আমার কোম্পানি থেকে চলে যেতে হলো। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন এক নিমিষে আমার হাতছাড়া হয়ে গেলো। ঘটনাটা আমাকে বেশ হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। পরের কয়েক মাস ধরে আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। মনে হচ্ছিলো আমি আগের প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছি; আমার হাতে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা আমি করতে পারিনি। একবার ভাবলাম ভ্যালি ছেড়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু ধীরে ধীরে একটি বিষয় অনুভব করতে লাগলাম। সেটা হচ্ছে, আমি আমার কাজকে এখনো ভালোবাসি! অ্যাপলের ঘটনাগুলো সেই সত্যকে এতোটুকু বদলাতে পারেনি। আমাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, কিন্তু আমি এখনো আমার কাজকে ভালোবাসি। তাই আবার একেবারে শূন্য থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু পরে আবিষ্কার করলাম অ্যাপল থেকে চাকরিচ্যুত হওয়াটা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো ঘটনা। বরং ভারমুক্ত হয়ে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সৃজনশীল সময়ের যাত্রা শুরু করলাম। পরবর্তী পাঁচ বছরে আমি নেক্সট এবং পিক্সার নামে দুটো কোম্পানি শুরু করি, আর প্রেমে পড়ি লরেন নামের এক অসাধারণ মেয়ের। তাকে আমি বিয়ে করি। পিক্সার থেকে আমরা পৃথিবীর প্রথম এনিমেশন ছবি ‘টয় স্টোরি’ তৈরি করি। পিক্সার এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সফল এনিমেশন স্টুডিও।
এরপর ঘটে কিছু চমকপ্রদ ঘটনা। অ্যাপল নেক্সটকে কিনে নেয় এবং আমি অ্যাপলে ফিরে আসি। এবং নেক্সট-এ আমরা যে প্রযুক্তি তৈরি করি সেটা এখন অ্যাপলের বর্তমান ব্যবসার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। অন্যদিকে লরেন আর আমি মিলে তৈরি করি একটা সুখী পরিবার। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, এগুলোর কিছুই ঘটতো না যদি না আমি অ্যাপল থেকে চাকরিচ্যুত হতাম। এটা ছিলো আমার জন্য খুব তেতো একটা ওষুধ। কিন্তু রোগীর জন্য সেটা দরকার ছিলো। কখনো কখনো জীবন তোমাকে মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে। তখন বিশ্বাস হারাবে না। আমি নিশ্চিত, যে জিনিসটা আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো সেটা হচ্ছে আমি আমার কাজকে ভালোবাসতাম। তোমাকে অবশ্যই তোমার ভালোবাসার কাজটি খুঁজে পেতে হবে। তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে যেভাবে খুঁজে পেতে হয়, ভালোবাসার কাজটিকেও তোমাকে সেভাবেই খুঁজে পেতে হবে। তোমার জীবনের একটা বিরাট অংশজুড়ে থাকবে তোমার কাজ, তাই জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে চমৎকার কোনো কাজ করা। আর কোনো কাজ তখনই চমৎকার হবে যখন তুমি তোমার কাজকে ভালোবাসবে। যদি এখনো তোমার ভালোবাসার কাজ খুঁজে না পাও তাহলে খুঁজতে থাকো। অন্য কোথাও স্থায়ী হয়ে যেও না। তুমি যখন তোমার ভালোবাসার কাজটি খুঁজে পাবে, তোমার মন আর সব গভীর জিনিসের মতোই গোপনে তোমাকে তা অনুভব করাবে। যে কোনো সম্পর্কের মতোই, তোমার কাজটি যতো সময় যাবে ততোই ভালো লাগবে। ৩. তোমরা নতুন, কিন্তু তোমাদের সময়ও সীমিত। অতএব, অন্য কারো জীবনযাপন করে সময় নষ্ট করো না। কোনো মতবাদের ফাঁদে পড়ো না, অর্থাৎ অন্য কারো চিন্তা-ভাবনা দিয়ে নিজের জীবন চালাবে না। তোমার নিজের ভেতরের শব্দকে অন্যদের চিন্তা-ভাবনার কাছে আটকাতে দেবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা,  নিজের মনের কথা শোনার সাহস রাখবে। মন ঠিকই জানে তুমি আসলে কী হতে চাও। বাকি সব কিছুও ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যখন তরুণ ছিলাম তখন একটা পত্রিকা বের হতো, নাম ছিল ‘The Whole Earth Catalog’। এটা ছিল আমার প্রজন্মের বাইবেল। এ পত্রিকা বের করেছিলেন স্টুয়ার্ড ব্র্যান্ড নামে এক ভদ্রলোক। তিনি পত্রিকাটিকে কাব্যময়তা দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। এটা ছিল ষাটের দশকের শেষ দিককার কথা। কম্পিউটার এবং ডেস্কটপ পাবলিশিং তখন শুরু হয়নি। তাই পত্রিকাটি বানানো হতো টাইপরাইটার, কাঁচি, এবং পোলারয়েড ক্যামেরা দিয়ে। পত্রিকাটিকে ৩৫ বছর আগের পেপারব্যাক গুগল বলা যায়। অনেক তত্ত্ব, তথ্যে সমৃদ্ধ আর মহৎ উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিল এটি।স্টুয়ার্ট এবং তার দল পত্রিকাটির অনেকগুলি সংখ্যা বের করে। পত্রিকাটির জীবন শেষ হয় একটি সমাপ্তি সংখ্যা দিয়ে। এটি ছিল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। আমার বয়স ছিল তোমাদের বয়সের কাছাকাছি।সমাপ্তি সংখ্যার শেষ পাতায় একটা ভোরের ছবি ছিল। তার নিচে ছিলো এই কথাগুলি : ‘ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো’। এটা ছিল তাদের বিদায়বার্তা। ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো। আমি নিজেও সবসময় এটা মেনে চলার চেষ্টা করি। আজ তোমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছেড়ে আরো বড় জীবনের গণ্ডিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছো, আমি তোমাদেরও এটা মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি : ক্ষুধার্ত থেকো। বোকা থেকো। (সূত্র: বাংলা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম)
 .....................................................................................................................................................................
বিশ্ব খাদ্য সংকট : বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি
Anu.Muhammad's picture

বিশ্ব ২০০৮ সালের মতো খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির পথে-এমন শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। সে সময়ে বিশ্ববাজারে চাল ও গমের মতো পণ্যের ঘাটতি ছিল যথেষ্ট। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, আমদানির জন্য যথেষ্ট অর্থ নিয়েও খাদ্য মিলছিল না। খাদ্য সংকট নিয়ে ফের আলোচনার সময় এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে : 'খারাপ আবহাওয়ার কারণে কয়েকটি দেশে উৎপাদন কম হয়েছে। এ কারণে কয়েকটি দেশের খাদ্যদ্রব্য রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এর মধ্যেই এশিয়ার দুটি জনবহুল দেশ চীন ও ভারতসহ কয়েকটি দেশে খাদ্যের চাহিদা বেড়ে চলেছে।' undefinedএ পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগজনক। এটা ঠিক, আমাদের খাদ্য চাহিদার বেশিরভাগ দেশেই উৎপন্ন হয়। বন্যা কিংবা অন্য কোন দুর্যোগে উৎপাদন ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত না হলে আমদানিনির্ভরতা প্রকট থাকে না। বলা যায়, মসলা এবং চিনি-ডাল-ভোজ্যতেলের মতো পণ্যে পরনির্ভরতা ব্যাপক হলেও চাল ও আটার ক্ষেত্রে তেমনটি নয়। কিন্তু বাজারদরের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চাল-গমের ক্ষেত্রে আমদানি মূল্য দেশীয় বাজার নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। খাদ্যদ্রব্যের বাজারে প্রধান জোগানদাররা বিশ্ববাজারের খোঁজ-খবর রাখে এবং নিজেদের লাভের অঙ্ক বাড়িয়ে নিতে তা কাজে লাগায়। দেশের বাজারে কৃষকরা কতটা খাদ্যশস্য সরবরাহ করল সেটাকে তারা আমলে নিতে চায় না। আর এ কারণেই বাজারে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যশস্যের বাজার অব্যাহতভাবে মনিটরের পাশাপাশি সরবরাহ বাড়াতে সর্বাত্মক চেষ্টা সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। সংকটের স্বরূপ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমপ্রতি গাজীপুরের এক অনুষ্ঠানে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের তাগিদ দিয়েছেন। এজন্য ন্যায্যমূল্যে কৃষকদের উৎপাদনের উপকরণ জোগান নিতে হবে সময়মতো এবং দামও রাখতে হবে নিয়ন্ত্রণে। কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমে বাড়িয়ে চলাও গুরুত্বপূর্ণ। আর স্বল্পমেয়াদে জরুরি হচ্ছে বিভিন্ন সূত্র থেকে আমদানি। আমরা যেহেতু স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃত, এ কারণে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সহায়তা চাইতে পারি। তাদের হিসাবেই বলা হয়েছে, বিশ্বের ১১০ কোটিরও বেশি লোক দিনে এক ডলারের কম দিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। তাদের মধ্যে ৯২ কোটিরও বেশি লোক অপুষ্টিতে ভুগছে। খাদ্যের দাম বাড়তে থাকলে তাদের কষ্টের বোঝা বাড়ে। ২০০৯ সালে বিশ্ব খাদ্য সংকট মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ২০০ কোটি ডলারের সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। গত বছর তারা ৩৫টি দেশের জন্য ১২৩ কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ স্বভাবতই বাড়বে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকেও তৎপরতা বাড়াতে হবে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে, তাই ক্রেতাদের বাস্তবতা মেনে নিতে হবে-এমন সরল অঙ্ক নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। ক্রেতারা বাজারে গিয়ে অগি্নমূল্যের সম্মুখীন হলে প্রথমে দোষ দেবে সরকারকে। তদুপরি রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। এখানেও সরকারের করণীয় রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের চাপে এক সময় রেশন ব্যবস্থা উঠে গিয়েছিল। এখন ফের তা চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে। বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বার্থই অবশ্যই ভাবতে হবে। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় এবং তখন পূর্ণিমার চাঁদকেও ঝলসানো রুটি মনে হয়-কিশোর কবি সুকান্তের কবিতায় যে নিষ্ঠুর বাস্তবতা প্রায় সাত দশক আগে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, এখন তা যেন আরও প্রাসঙ্গিক।


চালের বাজারের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে মজুদবিরোধী আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সারাদেশে এবার আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকদের কাছ থেকে সরকারিভাবে সেই ধান-চাল সংগ্রহ করা হয়নি। সেক্ষেত্রে চাতাল মিল মালিক ও ধান-চালের বড় ব্যবসায়ীরা মজুদ গড়ে তুলেছে বলে অভিযোগ উঠছে। দেশে হাজার হাজার চালকল গড়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে তারাই। পাইকারি ব্যবসায়ীরাও তাদের দিকে আঙুল তুলছে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই সংসদীয় কমিটির সভায় মজুদবিরোধী আইন প্রণয়নের সুপারিশ উত্থাপিত হয়। বৈঠকে সামপ্রতিক এক অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, উত্তরবঙ্গের প্রত্যেক চাতাল মালিক ৪ থেকে ৫ হাজার মেট্রিক টন ধান মজুদ করে রেখেছে। এ ধরনের উদাহরণ তুলে ধরেন কমিটির আরও ক'জন সদস্য।

মূলত ডিলারদের নিয়ন্ত্রণে একটি কঠোর মজুদবিরোধী আইনের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করা হচ্ছিল অনেকদিন ধরেই। এর অভাবে মজুদবিরোধী কার্যক্রম নাকি জোরালো হতে পারছে না। আইন প্রণয়নের পর মানুষ দেখতে চাইবে সরকারের মজুদবিরোধী কার্যক্রম কতটা জোরালো হয়। কোন আইন প্রণয়ন তখনই সার্থক হয়, যখন তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়। অনেক অপরাধ দমনে দেশে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় সেসবের কার্যকারিতা প্রায় নেই। মজুদবিরোধী আইনের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটবে না, এটাই আমরা আশা করব। পাশাপাশি চালের বাজার স্বাভাবিক রাখতে অন্য কার্যক্রমও জোরদার করতে হবে। শুধু মিল মালিক নয়, বড় ও মাঝারি কৃষক পর্যায়েও ধান-চাল মজুদের খবর রয়েছে। আজকাল অনেক ভোক্তাও একসঙ্গে ক'মাসের চাল কিনে রাখে। বাজার স্বাভাবিক থাকলে সব পর্যায়েই চাল মজুদের প্রবণতা কমত। চালকে ঘিরে বাণিজ্যিক মনোভাব বেড়ে ওঠার বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চালের বাজারের গতিপ্রকৃতির ওপরও তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখছে বড় ব্যবসায়ীরা। সমস্যা দেখা দেয় তখন, যখন এ বিষয়ে সরকারের উদাসীনতার সুযোগে তারা বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। সরকার চালের বাজার নিয়ে অসচেতন বলা যাবে না। দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায়ই তারা আমন সংগ্রহ অভিযান স্থগিত রেখেছেন; কিন্তু তাতে মনে হয় না লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। বরং ধান-চালের মজুদ গড়ে তুলেছে মিল মালিকরা। এ অবস্থায় নতুন আইন প্রণয়ন ও তার কার্যকারিতা নিশ্চিত করে তাদের মজুদ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিদেশি বাজার থেকে চাল সংগ্রহের মাধ্যমে সরকারি মজুদ বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। অবশ্য সরকার সে চেষ্টা করছে বলেই মনে হয়। ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানিরও খবর রয়েছে। তারপরও বলতে হয়, মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার সুযোগ নেই। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি মজুদ বাড়ানো অপরিহার্য। বোরোর ফলন যেন ভালো হয়, লক্ষ্য রাখতে হবে সেদিকেও। এ কার্যক্রম যেন কোনভাবেই ব্যাহত না হয়।

সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বলা হয়েছে, চালের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকার প্রধান কারণ চালের বাজার সিন্ডিকেট। নিত্যপণ্যের বাজারে এ ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের উপস্থিতির কথা অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে। সংসদীয় কমিটিও ২০০৯ সালের ডিসেম্বর থেকে বলে আসছে, সিন্ডিকেটের অন্তর্গত চাতাল মিল মালিক ও অসাধু চাল ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ নিয়ে ধান-চাল মজুদ করে রাখে। সেক্ষেত্রে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হলে আজ হয়তো চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো। আরও দাম বৃদ্ধি রোধে এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আমলে নেয়া দরকার। তারা চাল বিক্রি মনিটরিংয়ের জন্য ভিজিলেন্স টিম গঠনের পাশাপাশি গোটা খোলাবাজারের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। চাতাল মিল মালিক ও ধান-চালের বড় ব্যবসায়ীরা যাতে এক মাসের বেশি মজুদ রাখতে না পারে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও দিয়েছেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা।


বিশ্বব্যাপী ২০০৮-এর মতো খাদ্য সংকটের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে ইতোমধ্যে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম ৪০ শতাংশ আর তেলের দাম ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এতে খাদ্য সংকট ২০০৮ সালের মতোই হতে যাচ্ছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘ। সব দেশেই অব্যাহতভাবে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ঘটে চলেছে। ফাওয়ের হুঁশিয়ারিতে বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক ২০০৮ সালের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অনাহারের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। পর্যাপ্ত অর্থ হাতে নিয়েও খাদ্য আমদানি সম্ভব হবে না। কারণ খাদ্যশস্য উৎপাদন কম হয়েছে। ২০০৮ সালেও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভয়াবহ বন্যা হয়েছে পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ায়। ইউরোপ ও আমেরিকায় হয়েছে প্রবল তুষারপাত এবং রাশিয়ায় ঘটেছে স্মরণকালের ভয়াবহ খরা। এসব কারণে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। ফাওয়ের হিসাব মতে, এবার সারাবিশ্বে গম উৎপাদন কমেছে ৫ শতাংশ এবং ভুট্টার উৎপাদনও কমবে আনুপাতিক হারে। রাশিয়া ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গম রপ্তানি আদেশ বাতিল করে দিয়েছে। এটা একটা এলার্মিং সিদ্ধান্ত, সন্দেহ নেই।

খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী বৃহত্তম একাধিক দেশে খরা ও বন্যাজনিত কারণে উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় খাদ্যপণ্য সরবরাহ কমে গেছে। আর এজন্যই সংকটের আশঙ্কা ব্যাপক হয়ে উঠেছে। বিশ্বে প্রকৃতপক্ষে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য কমই উৎপাদিত হয়ে থাকে। এজন্য বন্যা-খরা বা ভিন্ন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে খাদ্য পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে ওঠে। খাদ্য সংকট কোন পর্যায়ে পেঁৗছতে পারে এবং এর প্রতিক্রিয়াই বা কি হতে পারে, তা এরই মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে তিউনিসিয়া ও আলেজেরিয়ায়। এই দুই দেশে খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা হওয়ায় পরিস্থিতি এখন জটিল হয়ে উঠেছে। তিউনিসিয়ায় সংকটের কারণে ইতোমধ্যে সে দেশের প্রেসিডেন্টকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। জর্ডানেও সংকট চলছে। চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া-এশিয়ার এই তিন জনবহুল দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যের লাগাম টানাই যাচ্ছে না। এসব দেশে দাম আরও বাড়তে পারে। ভারতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশে। যে কারণে ভারতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার বিব্রতকর অবস্থা সামাল দেয়ার জন্য চাল-গমের মজুদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করা ও চিনির মজুদ সীমা কমানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছে। চীনে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১.৭ শতাংশ (নভেম্বরের হিসাব)। বাজারে সরবরাহ ও মনিটরিং বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে চীন সরকার।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তার বিবৃতিতে বলেছেন, খাদ্যপণ্যের অগি্নমূল্য বিশ্বজুড়ে প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে আবারও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে খাদ্য সংকট চলাকালে সুদান ও নাইজেরিয়াসহ কয়েকটি দেশে খাদ্য দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এবারও সারাবিশ্বে বিশেষ করে এশিয়ার সরকারগুলো আশঙ্কা করছে সে ধরনের দাঙ্গার। এশিয়ার অন্যতম জনবহুল দেশ আমাদের বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে চাল, গমসহ খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে চলেছে। এখন ধান ওঠার ভরা মৌসুম, অথচ তরতর করে বেড়ে চলেছে চালের দাম। সেই সঙ্গে বাড়ছে অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও। আন্তর্জাতিক বাজারেও খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সন্তোষজনক খাদ্য মজুদ গড়ে তোলা ক্রমাগত কঠিন হয়ে পড়ছে। গত বছরের মধ্যভাগ থেকেই নিরাপদ খাদ্য মজুদের তাগিদ উচ্চারিত হলেও গত বছর খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এর মধ্যে মিলারদের ধান মজুদের কারসাজিও অব্যাহত রয়েছে। অথচ খাদ্যশস্যের বাম্পার ফলন হয়েছে। ভবিষ্যতের ভয়াবহ সংকটের আশঙ্কা সামনে নিয়ে এখন আমাদের খাদ্য মজুদ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। রাশিয়ার মতো অনেক দেশই খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যশস্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে হবে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ যেসব দেশ এখনও খাদ্য রপ্তানি করছে, সেসব দেশ থেকে আমদানির দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি তরফ থেকে বলা হয়েছে যে, চলতি অর্থবছরে চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ টনের স্থলে ১২ লাখ টন এবং গম সাড়ে ৭ লাখ টন থেকে ১০ লাখ টন করা হয়েছে। শুধু কথা নয়, দ্রুত আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এর পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর সর্বোচ্চ উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন নিরাপদ খাদ্য মজুদের বিকল্প নেই। খাদ্যপণ্য নিয়ে আমাদের ভাবনার লেভেল পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান খাদ্য মজুদ-পরিস্থিতি যা তাতে যদি বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব না হয়, তাহলে সংকটের আশঙ্কা থেকেই যাবে। আগামী বর্ষা মৌসুমে বন্যা হলে খাদ্য পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। সেজন্যই এখন খাদ্যশস্য প্রসঙ্গে এসওএস ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত ও তৎপরতা চালাতে হবে এবং বন্যা আসার আগেই নিরাপদ খাদ্য মজুদ গড়ে তুলতে হবে। কাউকে দোষারোপ নয়, সবাইকে নিয়ে সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে। লিংক
..........................................................................................
অরূপ রাহী   

সেকি অন্য তত্ত্ব মানে/মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে -লালন ফকির,  
‘একজন ‘ক্রিমিনাল’ হলো এমন একজন লোক, যার করপোরেশন গড়ার সব গুণই আছে, শুধু পুঁজি নাই’ -ক্ল্যারেন্স ড্যারো
১.
‘‘দেশে কোনো ‘ক্রসফায়ার’ হচ্ছে না।’’
কথা ঠিক। বাংলাদেশে দৃশ্যমান, আমলযোগ্য কোনো ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ শক্তি বা বাহিনী নেই, যারা বর্তমান রাষ্ট্রের বাহিনীর বিপক্ষে লড়তে চায় বা পারে। ফলে ‘ক্রসফায়ার’ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। ‘ক্রসফায়ার’ হতে দুটি পক্ষ লাগে। এখানে পক্ষ একটাই।
‘ক্রসফায়ার’ সিস্টেমের অংশ। কথা ঠিক। ক্রসফায়ার এই রাষ্ট্র-সিস্টেমের অংশ। রেডি আছে। যখন দরকার ব্যবহার করা হয়। সিস্টেমে আরো আছে : গুম, ভাগবাটোয়ারা, চাঁদাবাজি, ঘুষ, নানারকম নিপীড়ন-নির্যাতন ইত্যাদি। 
‘দেশে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটছে না’
এ কথাও ঠিক। ‘ক্রসফায়ার’ও একরকম বিচার। রাস্তার গণপিটুনিতে ছিনতাইকারী বা ছিঁচকে চোরের মৃত্যুতে হাততালি দিয়ে একধরনের বিচার অনুষ্ঠান করি আমরা। ক্রসফায়ার-বিচারের উৎপত্তি সেখান থেকেই। সমাজ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির রমরমা। রাষ্ট্র তো বগল বাজাবেই।
২.
কিন্তু কথা অন্যদিকেও আছে। ‘ক্রসফায়ার’ ক্রসফায়ার নয়। ফায়ার। রাষ্ট্র/শাসকগোষ্ঠী গুলি ছুড়ছে, ‘অপরাধী’ (আপদ) বিদায় করতে। এই আপদের তালিকায় আছে : ব্যক্তিগত ‘শত্রু’ (সাধারণ মানুষ, উঠতি ‘সন্ত্রাসী’, ছোট/মাঝারি রাজনৈতিক নেতা/ব্যবসায়ী); এবং রাষ্ট্রীয়/সামাজিক ‘শত্রু’ (ইসলামী/কমিউনিস্ট চরমপন্থী); গুরুতর অপরাধের নিরীহ/অনিরীহ সাক্ষী, এরকম আরো অনেকে। ‘শত্রু’/‘অপরাধী’/আপদ নির্ধারণের আপাত কোনো সাধারণ নিয়ম নেই। কিন্তু ‘শত্রুর’ ধরন-ধারণ দেখে নিয়মটা সহজেই বের করা যায়। সমাজ-রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এই তালিকায় পড়েন না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য ক্রসফায়ারে কেউ মারা পড়ে না, ভূমিদস্যুতার জন্যও না। পরিবেশ দূষণের জন্যও না। ঋণখেলাপির জন্যও না। সুদের কারবারির জন্যও না।  ভেজাল-খাদ্য ব্যবসার জন্যও না। শ্রমশোষণ-উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণের জন্যও না। দেশের সম্পদ বহুজাতিকের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যও না। সমাজ-রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এই তালিকায় না পড়ার সঙ্গত কারণ আছে। ‘অপরাধ’ এবং ‘বিচারে’র আইন তারাই তৈরি করেন। তাদের ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’-ই আজকের শাসনব্যবস্থা।
৩.
বোনাপার্ট-৩-এর প্রাইভেট আর্মি হিসেবে কুখ্যাত ‘সোসাইটি অব ডিসেম্বর টেন’ যাদের নিয়ে গঠিত, সেই ‘বোহেমিয়ান’দের একটা অংশই আজকের ক্রসফায়ারের শিকার। আজকের বোহেমিয়ান, যারা ক্রসফায়ারে পড়ছেন, তাদের মধ্যে আছে : খ্যাপাটে কবি, অফশুট/বেমানান বুর্জোয়া, ছিঁচকে চোর, রাস্তার ছিনতাইকারী, খ্যাপাটে বিপ্লবী, ইত্যাদি। নিরীহ আমজনতা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- এরা কীভাবে এই তালিকায় ঢুকে যায়? কারণ আমাদের সমাজ, আমাদের বাহিনী, আমাদের রাষ্ট্র বুর্জোয়া মানবাধিকার চর্চার সক্ষমতা অর্জন করেনি। ‘উন্নত’ বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলো তার নিজের টিকে থাকার ন্যায্যতা বজায় রাখতে নাগরিকদের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করতে বাধ্য হয় সমাজে এক ধরনের গণতন্ত্রায়নে। কিন্তু ওইসব রাষ্ট্রও বেকায়দায় পড়ে, যখন উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম হাজির হয়, যখন শ্রমশোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিক জেগে ওঠে, যখন বুর্জোয়া ‘সিভিলিটি’র ধার ধারে না কোনো ‘অফশুট’, তখন রাষ্ট্র তার আদিম, বর্বর চেহারায় হাজির হয়। রাষ্ট্র যেন ভুলে না যায়, আমরা যেন ভুলে না যাই, সিভিলিটি একটা বিশেষ আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার বিশেষ মানবিক প্রকাশ। এই প্রকাশের শর্ত পূরণ না করলে কেউই ‘মানবিক’ থাকে না, থাকতে পারে না। পশ্চিমে (পুঁজিবাদ ও বড়লোকের গণতন্ত্র) উদ্ভূত ‘মানবাধিকার’ তত্ত্বের মূল সমস্যা/সীমাবদ্ধতা এখানেই। যে ব্যবস্থা মানুষের (নারী-শিশু-পুরুষ-শ্রমিক-ভিন্ন সংস্কৃতি নির্বিশেষে) মর্যাদাপূর্ণ বাঁচার শর্তপূরণ করে না, সেই ব্যবস্থা ‘মানবাধিকার’ সংকটের মুখোমুখি হবেই। তার নিজস্ব নৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক দাবিদার অনেক রাষ্ট্রের ‘মানবাধিকার’ সংকটেও পশ্চিমা মানবাধিকার ধ্বজাধারীদের উল্লেখ করার মতো কোনো অর্জন নেই। এই সংকটের সমাধান পুঁজিবাদী-বড়লোকী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে উদ্ভূত ‘মানবাধিকার’ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সম্ভব হয় না, হবে না। যে কারণে আমরা শত শত মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ শুনতে পাই, বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যানের মিনতি শুনতে পাই, কিন্তু না বাংলাদেশ রাষ্ট্র, না দুনিয়ার অন্য কেনো রাষ্ট্র ‘মানবিক’ হয়ে উঠছে। ‘মানবিক’ রাষ্ট্র কি অসম্ভব? জাতিসংঘ ঘোষিত ‘সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা’য় যা যা বলা আছে, তার কোনোটাই  পুঁজিবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না। এই ঘোষণায় শ্রমশোষণকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মনে করা হয় না। ন্যায্য মজুরির কথা বলা হয়, কিন্তু ন্যায্য মজুরির মতো ভোগ-ভুয়া আইডিয়া আর হয় না। এটা কত ভুয়া আইডিয়া, তা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন কাঠামোর দিকে তাকালেই চলে। দুনিয়ায় এখনো শ্রমদাসত্ব চলছে। ‘মানবাধিকার’ সংগঠনগুলো এখনো করপোরেটবান্ধব ‘ন্যায্য মজুরি’ তত্ত্বেই আস্থা রেখেছে। পশ্চিমা মানবাধিকার তত্ত্বের কি সেই সীমাবদ্ধতা? প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো এই ঘোষণা সার্বজনীনতার কথা বলে। কিন্তু বিশেষ স্থান-কাল-সংস্কৃতির মানুষের ক্ষেত্রে এই ‘সার্বজনীনতা’ কীভাবে কাজ করবে, তা স্পষ্ট না। আমরা খেয়াল করলে দেখব, ঘোষণায় ‘সার্বজনীনতার’ কথা বলা হয়। কিন্তু তা বড়লোকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড়লোকদের জন্য তো নয়ই। তারা আলাদা। বিশেষ। গরিবরা মানবাধিকার চাইবে। বড়লোকরা দেবে। এটা দাতা-গ্রহীতা সম্পর্ক। কারণ রাষ্ট্র বড়লোকের। বড়লোকরাই রাষ্ট্র। বড়লোকরা, বহুজাতিক করপোরেশনরা বরং, এই ছদ্ম সার্বজনীনতা রাষ্ট্র এবং তার মালিকশ্রেণীর, বহুজাতিক করপোরেশনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নানান কায়দা-কৌশলে ব্যবহৃত হয়। গুয়ানতানামো-বের খবর আমরা জানি।  ‘মানবাধিকার’ লঙ্ঘনের দায়ে কেউ কি এখনো পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার করতে পেরেছে? ব্যক্তি মালিকানাভিত্তিক নাগরিক গণতন্ত্র এথেন্স হয়ে রোমান সাম্রাজ্য হয়ে ‘আধুনিক’ ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছে। এথেনীয়… গণতন্ত্রে বড়লোক নাগরিকরা নিজেরাই শাসক, নিজেরাই শাসিত ছিলেন। পুঁজিবাদের বিকাশের এ পর্যায়ে আধুনিক রাষ্ট্র নিজের ভাষায় নাগরিকত্বের সীমানা বৃদ্ধি করে তা ‘মানুষ’ পর্যন্ত পৌঁছানোর ঘোষণা দেয়। দাসবিদ্রোহ, উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন, নারী আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন ইত্যাদি- তাদের এই ঘোষণা দিতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ‘মানুষ’-এর সংজ্ঞাই তো নির্ধারিত নয়। ‘আধুনিক মানুষ’-এর যে ছবি দুনিয়ায় প্রভাবশালী, সে তো একজন ‘পশ্চিমা সিভিল বুর্জোয়া’। যে আত্মরক্ষার নামে আগ্রাসন করে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। এই ‘আধুনিক’ মানুষের বাইরের গণমানুষ আছে। পশ্চিমেও, পূর্বেও।
৪.
সমাজ থেকে ‘সন্ত্রাস’ দূর করার জন্য ‘ক্রসফায়ার’/‘এনকাউন্টার’/‘বন্দুকযুদ্ধ’ করা হচ্ছে। সমাজে ‘সন্ত্রাস’ দূর করতে রাষ্ট্র সন্ত্রাস করছে। রাষ্ট্রের এই সন্ত্রাস কি ন্যায্য? রাষ্ট্রের এই সন্ত্রাস চলতে থাকলে কি সমাজ থেকে ‘সন্ত্রাস’ দূর হবে? অসম্ভব। বড়লোকের রাষ্ট্র নিজেই একটা সন্ত্রাসী ব্যবস্থা। উদ্বৃত্তশ্রম শোষণের ব্যবস্থা জারি রাখতে রাষ্ট্রের বাহিনী/মেশিনারিজ ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রের বাহিনীর সঙ্গে গণমানুষের দূরত্ব ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র শ্রমিক মারে, আদিবাসী মারে, কৃষক মারে। বড়লোকরা নিজেরা নিজেরা চেষ্টা করে আপস-মীমাংসা করে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ম্যানেজ করতে। যখন তা আর সম্ভব হয় না, তখন যদি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক শক্তি সমাজে হাজির না থাকে, তখন সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা হাতে নেয়। তখন এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। একচেটিয়া হয়। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শক্তি জোরদার নয়। বাংলাদেশে তাই রাষ্ট্রের একচেটিয়া সন্ত্রাস। রাষ্ট্রের এই নিরঙ্কুশ সন্ত্রাসের বাইরে আর কোনো সন্ত্রাসকে বুর্জোয়া রাষ্ট্র নিজের জন্য হুমকি মনে করে। তার কর্তৃত্ব সংকটে পড়ে। তাই সে তার মতো করে বিচার ও অবিচার ব্যবস্থা সাজায়। আদালতও চলে; গুম, ক্রসফায়ারও চলে। এটা করতে গিয়ে রাষ্ট্র, এমনকি সবচেয়ে ‘উদার’ রাষ্ট্রও নিজের এবং সমাজে ‘সন্ত্রাসের’ কারণ, উৎস ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে একচোখা হয়ে পড়ে। যে কারণে সে একই ক্রসফায়ারে বড়লোক বাদে আর সবাইকে ফেলতে পারে। তা সে খ্যাপাটে কবি, অফশুট/বেমানান বুর্জোয়া, ছিঁচকে চোর, রাস্তার ছিনতাইকারী, খ্যাপাটে বিপ্লবী (ইসলামী/কমিউনিস্ট), যেই হোক। আর রাষ্ট্রের হাত অনেক লম্বা হলেও হাতের শেষ অংশ অনেক সময়ই মাথার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় ব্যক্তির স্বার্থচরিতার্থ করার চর্চা তো আর নতুন না। এই ‘ব্যবস্থার’ মধ্যে আমজনতা, নিরীহ ছাত্র গুম হওয়া, ক্রসফায়ারে পড়া অসম্ভব কিছু না।  তাতে রাষ্ট্রের কিছু আসে যায় না।
‘ক্রসফায়ার’/‘এনকাউন্টার’/‘বন্দুকযুদ্ধ’ দিয়ে  ‘সন্ত্রাসের’ কিছু লক্ষণ দূর হয়,  কারণগুলো নয়, ফলে ‘সন্ত্রাস’ চলতেই থাকে, ‘সন্ত্রাসী’ পয়দা হতেই থাকে। অন্যায়-সন্ত্রাসভিত্তিক রাষ্ট্র-সমাজই নানারকম ‘সন্ত্রাসে’র জন্মদাতা। আদিম সঞ্চয়ন থেকে আজকের করপোরেট পুঁজির বিশ্ববিস্তার। এই যাত্রাপথে গড়ে ওঠা এই রাষ্ট্রই, এই সমাজই, প্রতিমুহূর্তে ‘সন্ত্রাসী’ জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াই চলছে ‘সভ্যতায়’। কেন কেউ একজন সন্ত্রাসী হয়? কেন কেউ একজন চুরি করে, পকেটমার হয়? কেন কেউ একজন ‘সন্ত্রাসবাদী’ হয়? ‘চরমপন্থী’ হয়? কেন কেউ আত্মঘাতী ‘বিপ্লবী’ হয়- এসব প্রশ্নের মুখোমুখি কি এই রাষ্ট্র-সমাজ সৎভাবে হওয়ার চেষ্টা করেছে? আমরা তা মনে করি না। সময় এসেছে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার। রাষ্ট্র এসব ‘শত্রু’/‘অপরাধী’র সঠিক জবানবন্দিও কেন আদালতের মাধ্যমে নাগরিকদের জানতে দেয় না? নাগরিকরা কেন জানতে চায় না এসব প্রশ্নের উত্তর? এসবই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র-সমাজের লক্ষণ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সিরাজ সিকদারকে হত্যার মাধ্যমে যে ফ্যাসিস্ট খুনের শাসনের নতুন পর্ব শুরু হয়েছে, তার ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যা, রাষ্ট্রের বাহিনীর হাতে নিপীড়ন-হত্যার প্রক্রিয়া আরো গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে। আওয়ামী-বিএনপি-জামায়াত-জাপা এসব ফ্যাসিস্ট শক্তি, শাসকশ্রেণীর এই ধারা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
‘বিশৃঙ্খলা’, ‘পাগলামি’, ‘সন্ত্রাস’ ইত্যাদির প্রচলিত, প্রভাবশালী সংজ্ঞা তো পুঁজিবাদের সাপেক্ষে তৈরি। যা কিছু পুঁজিবাদ ও ‘বড়লোকের গণতান্ত্রিক’ পরিবেশে ‘উপদ্রব’, তাই ‘বিশৃঙ্খলা’, ‘পাগলামি’, ‘সন্ত্রাস’। আনসিভিল। তাকে শেষ করে দাও। জেলে পুরো। পাগলা গারদে পাঠাও। ভালো হয় যদি মেরে ফেলতে পার। গুম করে ফেলতে পারলে আরো ভালো। তখন আর ‘নাগরিক’ অধিকারের প্রশ্ন নেই। আর ‘সিভিল’ উপদ্রবকে কিনে নাও, হজম করে ফেল।
৫.
‘মানুষ’ কে? ‘মানুষ’ কোথায়? ‘মানব’ কারে বলে? মানুষ, মানবতা কোনো চিরায়ত সত্তা নয়। এটা একটা স্বনির্মাণ প্রক্রিয়া। মানুষের শ্রেণী-লিঙ্গ-বয়স-সংস্কৃতি পরিচয় আছে। শ্রেণীবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, বয়সবাদীতা, বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ- একেকটি পর্দা, একেকটি ভেদমূলক ব্যবস্থা, যা মানুষের মর্যাদার লঙ্ঘন করছে। সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার অন্যতম একটা কথা : নারীর অধিকারও মানবাধিকার। এই বক্তব্য পুরুষতন্ত্রের নিশানা আছে। এই বক্তব্য আমাদের জানান দিয়ে রাখে- পুরুষ আগেই অধিকার পেয়ে গেছে। অন্য লিঙ্গের অধিকার না পেলে পুরুষের অধিকার আদৌ আসবে কিনা সে প্রশ্ন উহ্যই থেকে যায়। লাতিন আমেরিকার জনগণ মা-পৃথিবীর (mother earth) অধিকারের প্রশ্ন তুলেছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে নিয়ন্ত্রণমূলক সম্পর্ক, তাও তো অন্যের অধিকার খর্ব করে, অন্যকে বঞ্চিত করে। ‘মানবাধিকার’কে এসব প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হবে। বিভেদের কারণ বজায় রেখে সার্বজনীন ‘মানুষ’, সার্বজনীন ‘মানবতা’ ও তার ‘অধিকার’ খোঁজা অবান্তর।
প্রচলিত ‘মানবাধিকার’ চিন্তা ও চর্চা রাষ্ট্র-করপোরেট শক্তির একচেটিয়া সন্ত্রাসী ক্ষমতার প্রয়োগ থেকে ‘নাগরিক’/সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্র ‘মানবাধিকার’কে ক্রসফায়ারে ফেলেছে। রাষ্ট্র এই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে সংবেদনশীল ‘মানুষ’দের প্রতি। নাগরিক হিসেবে আমরা ‘মানবাধিকার’ সংগঠনগুলোকে তাদের  ‘মানব’ ও ‘অধিকারের’ সংজ্ঞা পর্যালোচনার আহবান জানাই। ‘মানবাধিকারের’ পশ্চিমা, পুঁজিবাদী-পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও চর্চা থেকে বের হয়ে এসে, মিনতি ও  অনুযোগের চেয়ে কার্যকর কোনো ভাষা ও কৌশল তাদের বের করতেই হবে।
তাহলে কি আমরা ‘ক্রসফায়ার’ এবং আরো বিভিন্ন উপায়ে ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যার বিচার চাইব না? অবশ্যই চাইব। চলতি রাষ্ট্রব্যবস্থা, তার সংবিধান যে বিচার ব্যবস্থা তৈরি করেছে, নাগরিক হিসেবে আমরা সেখানে বিচার চাইতে অবশ্যই যাব। গিয়েছিও আমরা অনেকে। আমরা দেখেছি আদালতের রায় এবং উপদেশ এই রাষ্ট্র থোড়াই কেয়ার করে চলেছে। শাসকশ্রেণী জনগণের কাছে যে ন্যূনতম মানবিক অধিকারের অঙ্গীকার ভোটের খাতিরে, টিকে থাকার খাতিরে করে, সেটুকুও বাস্তবায়ন করে না। বারবার তার অসংখ্য উদাহরণ তৈরি করে চলেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটা শাসন ব্যবস্থায় ‘ন্যায়বিচার’ নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন নির্ভর করে শাসকশ্রেণী ন্যায়বিচার বলতে কি বোঝে এবং কি বুঝতে চায়, তার ওপর। উদাহরণ : অধিকাংশ দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে, দু-একটি দেশে নেই। কোনো দেশে চুরির দন্ড জেল, কোনো দেশে হাত কেটে ফেলা। সার্বজনীন ন্যায়বিচার, সার্বজনীন মানবাধিকারের মতোই একটি বিমূর্ত ধারণামাত্র। একে কোনো একটা ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার সাপেক্ষেই নির্মাণ করার, বিকশিত করার প্রশ্ন তাই সামনে এসে পড়ে। আমদানিকৃত, পশ্চিমা (পুঁজিবাদী-বড়লোকী গণতান্ত্রিক) ‘সুশাসনে’র বটিকা দিয়ে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। এই আমদানি করা ‘সুশাসন’ করপোরেট পুঁজির সেবক। গরিবের ভোটে বড়লোকের শাসন স্থায়ী করার তরিকা। মোটেই গণতান্ত্রিক কিছু নয়। মানবাধিকারের গণতান্ত্রিকচর্চা ও প্রয়োগের ঐতিহাসিক কোনো শর্তই বাংলাদেশ পূরণ করে না। কারণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যথেষ্ট গণতান্ত্রিক নয়। ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক শাসন, গণমানুষের মানবিক অধিকারের ধারণার ব্যাপক পর্যালোচনা, পরিবর্তন এবং সে সাপেক্ষে সমাজ ও রাষ্ট্রের অব্যাহত গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই কেবল একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নমুক্ত দেশ ও দুনিয়া গড়ে তোলা সম্ভব।
আমরা যদি ‘বদ্ধজীব’ দশা থেকে ‘রাজনৈতিক প্রাণী’ হয়ে উঠতে না পারি, রাষ্ট্র ও সমাজের পরিসরে মানুষ হিসেবে আমাদের যে তুলনামূলক সার্বভৌমত্ব আছে, আমাদের ন্যায্যতার বোধ থেকে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে তার চর্চা যদি না করি, সমাজকে যদি আমরা ন্যায়ভিত্তিক করার বদলে নিজেরা কেবলই এই অন্যায় সমাজের জানের ছদকায় পরিণত হই, তাহলে ব্যাপক অর্থে একটা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ আশা করা বাতুলতা। ইতিহাসের এই পর্বে তাই প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মানুষ হওয়ার, গণতান্ত্রিক মানুষ তৈরি হওয়ার বাতাবরণ সৃষ্টির সাধনা করা। শ্রম-শোষণভিত্তিক ব্যক্তিমালিকানার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা  পুরুষতান্ত্রিক-পুঁজিতান্ত্রিক মানবতার সংস্কার দূর করা। সেটাই হবে মানবতার নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ।


অরূপ রাহী : কবি, লেখক ও সঙ্গীতশিল্পী। দলনেতা, গানের দল লীলা
প্রকাশিত : সাপ্তাহিক বুধবার, ১৭ মার্চ-১১। লিংক: http://budhbar.com/?p=4631

আজ পিতা কন্যার বিপক্ষে, বোনের বিরুদ্ধে ভাই

 মাসুদা ভাট্টিবাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতায় নারীর অবস্থানটি যে কতটা নাজুক, তা প্রমাণ করে দিল ৪ এপ্রিল ডাকা হরতালের ঘটনা। সরকারপক্ষ দাবি করছে কোনো হরতালই হয়নি, কেবল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত মাদ্রাসাছাত্রদের সশস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় বের করে এনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ছাড়া। আর যিনি হরতাল ডেকেছেন, সেই আমিনী সাহেব তো বলেছেনই যে এটাই নাকি আওয়ামী লীগের এই আমলে সবচেয়ে সফল হরতাল। হরতাল সফল কিংবা বিফল সে বিতর্কে না গিয়ে এ কথা বলাই যায় যে এ হরতাল আসলে এই সমাজের পুরুষতান্ত্রিক চেহারাটি ভয়ংকরভাবে উন্মোচন করেছে এবং পরিবারের পুরুষ সদস্যদের তা পিতা, স্বামী কিংবা ভাই-ই হোক না কেন; পরিবারের নারী সদস্যদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই দ্বান্দ্বিক অবস্থান থেকে কোনো মুক্তমনা পুরুষ চাইলেই বেরিয়ে আসতে পারবেন না।
মজার ব্যাপার হলো, যেকোনো সরকার এমনকি বিএনপি-জামায়াত সরকারও যখন নারীবিষয়ক কোনো কিছু ঘোষণা করে তখনই একটি পক্ষ ধর্মের দোহাই দিয়ে নেমে যায় তার বিরোধিতা করতে। স্মরণ করা যেতে পারে, বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে নারীনীতি ঘোষণার কথা বলা হলেও তৎকালীন মহিলাবিষয়ক মন্ত্রী সেলিমা রহমান নিজে উদ্যোগী হয়ে নারীনীতির বিরোধিতা করেন এবং তা ঘোষণা থেকে বিরত থাকেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী উদ্যোগী হয়ে নারীনীতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। কে না জানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমন অনেক কিছুই করা হয়েছে, যা অনৈতিক, দেশের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও সংবিধানপরিপন্থী। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই নীতির বিরুদ্ধে জরুরি অবস্থার মধ্যেও হাজার হাজার মাদ্রাসাছাত্র রাজপথে মিছিল বের করে ও ভাঙচুর চালায়, তাতে জরুরি অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিলে জরুরি সরকারের বাহিনীর নির্দয় লাঠিচার্জ আমাদের অসহায়ত্বকে যে কতটা প্রকট করে তুলেছিল, তা সেই সময়ের যেকোনো সুস্থ বিবেককে প্রশ্ন করলেই বেরিয়ে আসবে।
এর সরল অর্থ দাঁড়ায় যে নারীনীতি, এতে যা-ই থাকুক না কেন, তা যাতে অনুমোদন না হয় সে জন্য তৎপর কেবল ধর্মভিত্তিক দলগুলো নয়; বরং অনেক উদার রাজনীতিক ও তাদের দলও মৌন থেকে কিংবা এই ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সহিংস প্রতিবাদের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্ট করছেন আমাদের সামনে। একজন পরিচিত মানুষ ৪ এপ্রিল হরতাল চলাকালে স্পষ্টতই বললেন যে সত্যিই তো আমার স্ত্রীকে যদি আমার সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে দিতে হয়, তাহলে তিনি সে সম্পত্তি নিয়ে যেকোনো সময় আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। হাসি পেল ভেবে যে সম্পদের অর্ধেক দিলেই (যদিও নারীনীতিতে এমন কথা কোথাও লেখা নেই) নারীটি তাঁর স্বামীকে ফেলে অন্যত্র চলে যাবেন। সম্পর্কটা আসলে কতটা নাজুক হলে একজন পুরুষ এ রকম কথা ভাবতে পারেন। এই ব্যবসায়ী, নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবা মানুষটিকে কিছু বলে বোঝাতে চাওয়াটা সময়ের অপচয়। এই ভদ্রলোকের দুটি কন্যাসন্তান, তিনি এও জানেন যে প্রচলিত আইনে তাঁর মৃত্যুর পর তার কন্যাসন্তানের চেয়েও নাকি তার ভাইয়ের পুত্রদের অধিকার তার সম্পদের ওপর বেশি। সে কারণে তিনি নারীনীতির একটু প্রশংসাও করলেন, কিন্তু স্ত্রীকে সম্পত্তি দেওয়ার যে তিনি ঘোরবিরোধী সে কথা তিনি রাখঢাক না রেখেই বললেন। আইন বিষয়ে আমার জ্ঞান-বুদ্ধি অনেক কম, সুতরাং তর্কে না যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আশ্চর্য হলাম একজন সম্পদশালী মানুষের চিন্তাভাবনা দেখে। নারীনীতির বিরোধিতাকারীর তালিকায় এ রকম সম্পদশালী পুরুষের সংখ্যা যে অসংখ্য তা বিশ্বাস করতে এমনিতেও কষ্ট হয়নি কখনো, এই ভদ্রলোকের ওই কথার পর তো আরো হলো না।
৪ এপ্রিল টেলিভিশনের পর্দায় পাজামা-পাঞ্জাবি কিংবা কাফনের কাপড় পরা, গলায় কোরআন ঝুলিয়ে হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসা যুবকদের দেখে একটি প্রশ্ন মাথায় এসেছে। এদের ঘরে যেসব নারী রয়েছেন, তাঁরা এ ব্যাপারে কী বলেন? তারা কি জানেন যে এই নারীনীতিতে আসলেই তাদের কী দেওয়া হয়েছে? আমি নিশ্চিত যে তাঁরা জানেন না। অপরদিকে এই কাফনের কাপড় আর গলায় কোরআন ঝুলিয়ে রাস্তায় নামা যুবকদেরও বেশির ভাগই হয়তো জানেন না যে নারীনীতিতে আসলেই কী আছে। তাদের এই নীতির ২৩ ধারাটি কেবল শোনানো হয়েছে, যেখানে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে নারীর প্রাপ্য কেমন হবে সে কথা বলা হয়েছে। হরতালপন্থীরা বলছে যে এই ধারাটি আসলে কোরআন এবং সুন্নাহবিরোধী এবং তাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়ে সরকার অন্যায় করেছে। এ বিশ্বাস নিশ্চয়ই বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ারও, নইলে তাঁর দল কেন পরোক্ষে এ হরতালে সমর্থন দিয়েছে? প্রশ্ন হলো, জিয়া বিকল্প কোনো নারীনীতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে পারেননি। অথচ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিরোধী দলের দায়িত্ব সেটা নয়, কোনো কিছুর বিরোধিতা করার আগে তার যুক্তি জনগণের সামনে তুলে ধরে তার বিকল্প কিছু জনগণের সামনে হাজির করতে হবে; যাতে জনগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে আগামী কুড়ি বছরেও এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেখা পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে ঘোর সন্দেহ রয়েছে। তবে খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনে বিশ্বাস করেন, তাহলে তাঁর ভাবা উচিত ছিল তাঁর দলের নারী সমর্থক ও নারী ভোটারদের কথা। একটি দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক জনগোষ্ঠীর (জনসংখ্যা সমীক্ষায় দেশে পুরুষের তুলনায় নারী বেশি বলে কেউ কেউ উল্লেখ করে থাকেন) জন্য সরকার একটি নীতিমালা করেছে। কারণ সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও ব্যক্তিমানুষের মানসিকতার কাছে এই গরিষ্ঠসংখ্যক জনগণ অবহেলা, নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার। তাই সামগ্রিক সমাজোন্নয়নের স্বার্থেই তাদের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন এবং রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় তাদের অংশগ্রহণও সুনিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নারীনীতি প্রণয়ন করে সরকার কোনো খারাপ কাজ করেছে বলে সুস্থ মাথার কেউ ভাবতে পারেন বলে বিশ্বাস করি না। এই নীতিতে অগ্রহণযোগ্য কিছু রয়েছে বলেও ভাবার অবকাশ নেই। কারণ ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের ভোটব্যাংক আহত করার জন্য দেশের ধর্মবাদী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যায়_এমন কিছু করতে পারে বলেও বিশ্বাস করার কোনোই কারণ নেই।
আলোচ্য এই নীতি এখনো আইনে পরিণত হয়নি, কেবল মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাভ করেছে। কে জানে, এই বিরোধিতার মুখে সরকার এটি আইনে পরিণত করা থেকে পিছু হটে কি না। হটলেও খুব একটা আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না। এই সমাজে, এই রাষ্ট্রে, এ ব্যবস্থায় নারী হয়ে জন্মানোর যে পাপ এর শাস্তি একজন নারী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ভোগ করে, তা একজন নারী মাত্রই জানেন। কেবল এই নীতির কারণে রাতারাতি নারীর অবস্থান পরিবর্তন হতো, তা যেমন ভাবার কারণ নেই; তেমনই এই নীতি বাস্তবায়িত না হলে নারীর অবস্থানের কোনো হেরফের হবে_সেটাও সত্য নয়। সমাজের প্রান্তিক নারীদের সংগ্রাম এক, মধ্যবিত্তের আরেক এবং উচ্চবিত্তের সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে যার অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকারের জন্য লড়ছে, এই যুদ্ধে তার পাশে কে থাকবে না থাকবে সে তোয়াক্কা না করলেও চলবে।
তবে যে কথা দিয়ে নিবন্ধ শুরু করেছিলাম, সে কথা দিয়েই শেষ করি। ধরা যাক, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের খাবার টেবিল। সেখানে বসেছেন স্বামী-স্ত্রী এবং দুটি সন্তান, যার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ঠিক তখন টিভিতে নারীনীতির জন্য হরতালের দৃশ্য দেখানো হচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে কাফনের কাপড় পরা যুবকদের সংঘর্ষ। এখন এই মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিভূ খাবার টেবিলে বসা মানুষগুলোর কে কোন অবস্থান গ্রহণ করবে, তার ওপরই আসলে নির্ভর করছে এই পরিবারের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক। এখানে বাবা ও ছেলে এবং মা ও মেয়ে দুটি পক্ষ গ্রহণ করবেন, নাকি উভয়েই নিজেদের আধুনিক মানুষ হিসেবে প্রমাণ করবেন এবং উভয় পক্ষই নিজেদের 'মানুষ' হিসেবে বিবেচনা করে দুটি নয়, একটি পক্ষ হিসেবেই বিবেচনা করবেন_তার ওপরই আসলে নির্ভর করছে আগামী দিনের সমাজে নারীর অবস্থান। এই খাবার টেবিল যদি এখন গোটা বাংলাদেশে স্থাপন করি এবং সবাই সবাইকে প্রশ্ন করি যে আমার পুত্র এবং আমার কন্যা কেন ভিন্ন হবে, কেন দুজনই 'মানুষ' বিবেচিত হবে না, কেবল তখনই এই সমাজ খানিকটা হলেও আধুনিক রূপ লাভ করবে। এখানে ধর্ম নয়, মানুষ মুখ্য, মানুষের সম্পর্ক মুখ্য, মানুষের অধিকার মুখ্য।

লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com                                  (প্রকাশিত: কালেরকন্ঠ ৬ এপ্রিল১১) লিংক: http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&archiev=yes&arch_date=06-04-2011&type=gold&data=Hotel&pub_no=482&cat_id=2&menu_id=23&news_type_id=1&index=2