ছোট গল্প

ছোট গল্প

ইয়াদ আলীর কোট
           - ফয়সাল মাহমুদ পল্লব
শ্রীহীন, ছেঁড়া, ময়লা, তালিমাড়া একটা কোট। ইয়াদ আলী নামক এ ভিক্ষুক কোটটি পরে ভিক্ষে করতো। ভিক্ষুকটিকে ঐ কোট পরে ভিক্ষে করতে দেখা সৌভাগ্য কি দূর্ভাগ্য বলতে পারবো না, তবে আমার চোখে পরেছে বহুবার। সেইবার পৌষমাসে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে ঝমঝম করে বৃষ্টি হলো। টেবুনিয়া শাপলা সিনেমা হল পেরিয়েই পাকা রাস্তার সাথে মস্ত জাম গাছ। কনকনে পৌষ বৃষ্টির মধ্যে ইয়াদ আলীকে প্রথম কোট পরা অবস্থায় দেখা গেল। দাঁড়িয়ে আছেন জামতলা। নির্বিকার, বাঁহাতে মোটা কাঁচা কঞ্চির লাঠি। কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে চলে গেলেন পাকা রাস্তা ধরে, বৃষ্টি কমে যাওয়ার পরেই। কোটটি তিনি কোথায় পেয়েছিলেন অথবা কে তাকে দান করেছিলো জানা যায়নি। 
আলু, পোটল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ এহন ভিক্ষের কাঁচা বাজার রাখতে ইয়াদালীর আর মানুষের দোকানে গিয়ে কাগুজে ঠোঙা চাইতে হতো না, কোটের বিভিন্ন পকেটে অনায়াসে রেখে হেঁটে যেতেন। কোট পড়ার সুবিধা বলতে যে এতোগুলি পকেট ব্যবহার করা যায় এই সুবিধাটুকু ইয়াদালী তার সন্দর্ভ জ্ঞানে বেড় করতে পেরেছিলেন তা বোঝা যায়। বোধকরি এ কারনেই শীত-গ্রীষ্মে তার নিত্য সঙ্গী হলো এই কোট।
তিনি কখনও ট্রেনে উঠেছেন কিনা, বাসে উঠেছেন কিনা অথবা সাইকেলে চড়েছেন কিনা তার প্রমান মেলে না। পায়ে হেঁটে দিনভর ভিক্ষে করে এনে নিজে রান্না করে খেতেন একটা ছোট্ট ঝুপড়ির ভিতর। রাত কাটাতেন সেখানেই। তার ঝুপড়ির চালা দিয়ে অনেক গ্রহ, নক্ষত্র এমনকি পূর্নিমার দুপুর রাতের চাঁদও দেখা গেছে, তাতে কি? চাদেঁর পিঠে মানুষ চড়েছিলো না ভেড়া চড়েছিলো তা ভাবার মতো সময় তার ছিলো না। তার ভাবনা ছিলো নয়েদ প্রমানিকের ছেলেদের বাড়ি থেকে আগামীকাল কত পয়সা ভিক্ষে দেবে, নাকি রোমেনা'র মা মুখ কালো করে বলে দেবে 'ভিক্ষে নেই যাও, শুক্কুরবেরে আসপে'।
আচ্ছা ইয়াদালী ভিক্ষুক কি সুখি মানুষ ছিলেন? সুখি মানুষের গায়ে নাকি জামা থাকে না-তাইলে ইয়াদালীর গায়েতো জামার চেয়েও দামী জিনিষ কোট, তাহলে সূত্রমতে ইয়াদালী ভিক্ষুক সুখি মানুষ ছিলেন না। ভাগ্যিস ইয়াদালী দুঃখি মানুষ ছিলেন নইলে আমাদের মতো মানুষদের সুখি মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতো না। উনার পরনে থাকতো পোড়া ইট রঙয়ের একটা ফুল প্যান্ট। প্যান্টের অনেক জায়গায় হাত সূচের সাদা সূতো তাকিয়ে থাকতো। টাকনুর উপরে হাটুর নিচে পুড়ু করে ভাঁজ করে রাখতেন প্যান্টটা। তার পায়ে থাকতো টায়ার কেটে বানানো একজোড়া সেন্ডেল, সেন্ডলটি দেখলেই বোঝা যেতো তার চলার সীমানা, কারন চলতে চলতে সেন্ডেলটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে রং পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। তার কোটের কোন বোতাম ছিলো না, অথবা ইয়াদালীর জানাই ছিলোনা যে কোটে কোন বোতাম থাকে। তবে কোটে বোতামের কয়েকটা ঘাঁট ছিলো। 
খুব বেশী জানা সম্ভব হয়নি, তাঁর সংসার জীবন, দাম্পত্য জীবন, ধর্মজীবন, আত্মিয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কে। তবে তাঁর মা ভিক্ষে করতেন, এমনকি মা-ছেলে একসাথে ভিক্ষে করতেন এমন প্রমাণ মেলে। 
কনকনে ঠান্ডা পৌষে এই মায়াময় পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ইয়াদালী। ছেলের লাশ দেখে তার মা কাঁদতে পারছিলেন না, অথবা কান্নার মতো শক্তি তার ছিলো না। তবে ইয়াদালীর গায়ে কাফন পরানোর আগে খুলে নেওয়া হয়েছিলো সেই কোটটি। দাফন করার কিছুক্ষণ পূর্বে আচমকা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। ইয়াদালীর মৃত্যুতে কেউ কেঁদেছিলো কি না জানা যায়নি-তবে বৃষ্টি হয়েছিলো। শ্রীহীন, ময়লা, তালিমাড়া একদলা মেঘ থেকে বৃষ্টিটুকু ঝড়েছিলো।