মাদার
তেরেসা জন্ম ২৫ আগস্ট ১৯১০। তিনি ছিলেন একজন আলবেনিয়ান-বংশোদ্ভুত, ভারতীয়
ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী। ১৯৫০ সালে কলকাতায় তিনি মিশনারিজ অফ চ্যারিটি নামে
একটি সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন । সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি দরিদ্র,
অসুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা করেছেন।
সেই
সঙ্গে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির বিকাশ ও উন্নয়নেও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন ।
প্রথমে ভারতে ও পরে সমগ্র বিশ্বে তার এই মিশনারি কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে ।
তার মৃত্যুর পর পোপ দ্বিতীয় জন পল তাকে স্বর্গীয় আখ্যা দেন; এবং তিনি
কলিকাতার স্বর্গীয় টেরিজা নামে পরিচিত হন । ১৯৭০-এর দশকের মধ্যেই সমাজসেবী
এবং অনাথ ও আতুরজনের বন্ধু হিসেবে তার খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
ম্যালকম মাগারিজের বই ও প্রামাণ্য তথ্যচিত্র সামথিং বিউটিফুল ফর গড তার
সেবাকার্যের প্রচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ।
১৯৭৯ সালে তিনি তার সেবাকার্যের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার ও ১৯৮০ সালে
ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন লাভ করেন। তিনি ছিলেন নিকোলো ও
দ্রানা বয়াজুর কনিষ্ঠ সন্তান। তাদের আদি নিবাস ছিল আলবেনিয়ার শ্কড্যর্
অঞ্চলে ।
তার পিতা আলবেনিয়ার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯১৯ সালে এক
রাজনৈতিক সমাবেশে তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন । এই অসুখেই তিনি মারা যান।
১৯১৯ সালে মাত্র আট বছর বয়সে তার পিতৃবিয়োগ হয়। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর
মা তাঁকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন। ১২ বছর বয়সেই তিনি
ধর্মীয় জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ
করে একজন মিশনারি হিসেবে যোগ দেন সিস্টার্স অফ লোরেটো সংস্থায় । মা আর
বোনের সঙ্গে আর তার কোনোদিন দেখা হয়নি । তাঁর বাবা ছিলেন বহু ভাষাবিদ
নিকোলাস বাইয়াঝিউ, মায়ের নাম ড্রানা বাইয়াঝিউ । ১৯২৯ সালে ভারতে এসে
দার্জিলিঙে নবদীক্ষিত হিসেবে কাজ শুরু করেন । ১৯৩১ সালের ২৪ মে তিনি
সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি মিশনারিদের
পৃষ্ঠপোষক সন্ত Thérèse de Lisieux –এর নামানুসারে টেরিজা নাম গ্রহণ করেন।
১৯৪৮
সালে দরিদ্রের মাঝে মিশনারি কাজ শুরু করেন। প্রথাগত লোরেটো অভ্যাস ত্যাগ
করেন। পোশাক হিসেবে পরিধান করেন নীল পারের একটি সাধারণ সাদা সুতির বস্ত্র। এ
সময়ই ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বস্তি এলাকায় কাজ শুরু করেন। প্রথমে
একটি ছোট স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে ক্ষুধার্ত ও
নিঃস্বদের ডাকে সাড়া দিতে শুরু করেন। তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে
থাকেন । তার এই কার্যক্রম অচিরেই ভারতীয় কর্মকর্তাদের নজরে আসে। স্বয়ং
প্রধানমন্ত্রীও তার কাজের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। প্রথম দিকের এই দিনগুলো তার
জন্য বেশ কষ্টকর ছিল। এ নিয়ে ডায়রিতে অনেক কিছুই লিখেছেন । সে সময় তার
হাতে কোন অর্থ ছিল না। গরীব এবং অনাহারীদের খাবার ও আবাসনের অর্থ জোগাড়ের
জন্য তাকে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো। ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ
করতে হতো। এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ই হতাশা, সন্দেহ ও একাকিত্ব বোধ
করেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, কনভেন্টের শান্তির জীবনে ফিরে গেলেই বোধহয়
ভাল হবে ।
১৯৫২
সালে মাদার তেরেসা কলকাতা নগর কর্তৃপক্ষের দেয়া জমিতে মুমূর্ষুদের জন্য
প্রথম আশ্রয় ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলেন । ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায়
একটি পরিত্যক্ত হিন্দু মন্দিরকে কালিঘাট হোম ফর দ্য ডাইং-এ রূপান্তরিত করেন
। এটি ছিল দরিদ্র্যদের জন্য নির্মিত দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র । পরবর্তীতে
এই কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে রাখেন নির্মল হৃদয় । এই কেন্দ্রে যারা
আশ্রয়ের জন্য আসতেন তাদেরকে চিকিৎসা সুবিধা দেয়া হতো এবং সম্মানের সাথে
মৃত্যুবরণের সুযোগ করে দেয়া হয় । মুসলিমদেরকে কুরআন পড়তে দেয়া হয়,
হিন্দুদের গঙ্গার জলের সুবিধা দেয়া হয় আর ক্যাথলিকদের প্রদান করা হয়
লাস্ট রাইটের সুবিধা । এ বিষয় তেরেসা বলেন, “A beautiful death is for
people who lived like animals to die like angels — loved and wanted.”
অচিরেই মিশনারিস অফ চ্যারিটি দেশ-বিদেশের বহু দাতা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির
দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয় । এর ফলে অনেক অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় ।
১৯৬০-এর দশকের মধ্যে ভারতের সর্বত্র চ্যারিটির অর্থায়ন ও পরিচালনায়
প্রচুর দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, এতিমখানা ও আশ্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ।
ভারতের বাইরে এর প্রথম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে ভেনিজুয়েলায় ।
মাত্র ৫ জন সিস্টারকে নিয়ে সে কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।
নোবেল
পুরস্কার গ্রহণের সময় মাদার তেরেসাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কীভাবে আমরা
বিশ্ব শান্তির পথে অগ্রসর হতে পারি ?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘গো হোম
অ্যান্ড লাভ ইয়োর ফ্যামিলি ।’ (নিজের দেশে ফিরে যাও, নিজ পরিবারকে
ভালোবাস)। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের মধ্যে
সৃষ্টিকর্তা বাস করেন । আমি যখন কোনো কুষ্ঠরোগীর ক্ষত পরিষ্কার করি, তখন
অনুভব করি, আমি যেন স্রষ্টারই সেবা করছি । এর চেয়ে সুখময় অভিজ্ঞতা আর কী
হতে পারে !
মাদার
তেরেসা ইথিওপিয়ার ক্ষুধার্তদের কাছে যেতেন, ভ্রমণ করতেন চেরনোবিল বিকিরণে
আক্রান্ত অঞ্চলে । আমেরিকার ভূমিকম্পে আক্রান্তদের মাঝে সেবা পৌঁছে দিতেন ।
১৯৯১ সালে মাদার তেরেসা প্রথমবারের মত মাতৃভূমি তথা আলবেনিয়াতে ফিরে আসেন
। এদেশের তিরানা শহরে একটি “মিশনারিস অফ চ্যারিটি ব্রাদার্স হোম” স্থাপন
করেন । ১৯৯৬ সালে পৃথিবীর ১০০ টিরও বেশি দেশে মোট ৫১৭টি মিশন পরিচালনা
করছিলেন । মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে যে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল
সময়ের ব্যবধানে তা কয়েক হাজারে পৌঁছোয় । তারা সবাই বিভিন্ন দেশের প্রায়
৪৫০টি কেন্দ্রে মানবসেবার কাজ করে যাচ্ছিল । ১৯৮৩ সালে পোপ জন পল ২ এর
সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রোম সফরের সময় মাদার তেরেসার প্রথম হার্ট
অ্যাটাক হয় । ১৯৮৯ সালে আবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তার দেহে কৃত্রিম
পেসমেকার স্থাপন করা হয় । ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া
হওয়ায় হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে । এই পরিস্থিতিতে তিনি মিশনারিস অফ
চ্যারিটির প্রধানের পদ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন । কিন্তু চ্যারিটির
নানরা গোপন ভোটগ্রহণের পর তেরেসাকে প্রধান থাকার অনুরোধ করে । অগত্যা
তেরেসা চ্যারিটির প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন । ১৯৯৭ সালের ১৩ই
মার্চ মিশনারিস অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাড়ান । ৫ই সেপ্টেম্বর
মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুর সময় মাদার তেরেসার মিশনারিস অফ চ্যারিটিতে
সিস্টারের সংখ্যা ছিল ৪,০০০; এর সাথে ৩০০ জন ব্রাদারহুড সদস্য ছিল । আর
স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ছিল ১০০,০০০ এর উপর । পৃথিবীর ১২৩টি দেশে মোট ৬১০ট৫ই
মিশনের মাধ্যমে চ্যারিটির কাজ পরিচালিত হচ্ছিল । এসব মিশনের মধ্যে ছিল
এইড্স, কুষ্ঠরোগ ও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, সুপ
কিচেন, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, এতিমখানা ও বিদ্যালয় ।
মাদার
তেরেসার নোবেল বক্তৃতা- আমি চাই আপনারা দরিদ্রদের খুঁজে বের করবেন, সেটি
শুরু হোক নিজের বাড়ি থেকেই । সেখান থেকেই ভালোবাসার শুরু হোক । নিজের
জনগণের জন্য ভালো খবর হয়ে উঠুন । নিজের বাড়ির পাশের প্রতিবেশীদের খোঁজ করুন
। আজকের এই অনুষ্ঠানে একত্র হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য আসুন সৃষ্টিকর্তাকে
ধন্যবাদ জানাই । শান্তির উপহারটির জন্য ধন্যবাদ জানাই । এটি এমন উপহার, যা
মনে করিয়ে দেয় আমাদের শান্তি-পূর্ণভাবে জীবনযাপনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে ।
পাশ্চাত্যে অনেক তরুণ ছেলেমেয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম
। এটি কেন হচ্ছে খুঁজে বের করার চেষ্টা আমি করেছি । উত্তর হলো, পরিবারে
এমন কেউ নেই যে তাদের আদর-যত্ন করবে । মা-বাবা এতই ব্যস্ত থাকেন যে, তাদের
কোনো সময় থাকে না । শিশুরা মা-বাবার সানি্নধ্য না পেয়ে অন্য কিছুতে ব্যস্ত
হয়ে পড়ে । দরিদ্র মানুষরা মহান । তারা আমাদের অনেক সুন্দর বিষয় শিক্ষা দেন ।
এক বিকেলে আমরা ঘুরতে বেরিয়েছিলাম । রাস্তায় আমরা চারজনকে অসুস্থ অবস্থায়
দেখতে পাই । তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল । আমি তখন আমার
সঙ্গী সিস্টারকে বললাম, আপনি বাকি তিনজনের দায়িত্ব নিন । আমি অপেক্ষাকৃত
বেশি অসুস্থ নারীটির সেবার দায়িত্বে থাকি । ভালোবেসে যতটা করা সম্ভব তার
সবটুকুই আমি তার জন্য করলাম । আমি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম । তার চেহারায়
আমি মনকাড়া হাসি দেখতে পেলাম । সে আমার হাত ধরল এবং কেবল একটি শব্দ বলল,
ধন্যবাদ । তারপর সে মারা গেল ।