বাঙ্গালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন একটি নতুন অধ্যায়ের সুচনা করে। আমাদের মুক্তি সংগ্রামে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব Ab¯^xKvh©| বাংলা ভাষার উপর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও মুসলিম লীগ চক্রের আক্রমন ছিল মূলত বাঙ্গালী জাতির আবহমান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, হাজার বছরের ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের উপর আঘাত। এই আক্রমন পাকিসতানীদের পূর্ব বাংলার অর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে শাসন, শোষন ও লুন্ঠনের ধারাবাহিকতারই অংশ। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেও উপর এই আঘাত প্রতিহত করতে গিয়ে বাঙ্গালীজাতি সৃষ্টি করে এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের। এই ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রাম থেকে রাজনৈতিক আত্ম-নিয়ন্ত্রণের লড়াই নতুন মাত্রা অর্জন করে। এখান থেকে শুরূ হয় বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলন পাকিস্তান রাষ্ট্র তথা ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীত ধারায় প্রতিস্থাপিত ছিল।
ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষার বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি ইসলাম ধর্মের সাথে সঙ্গতপূর্ণ নয় প্রধানত এই হীন মোনবৃত্তি ও যুক্তি থেকে বৈরিতার সুত্রপাত হয়। বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরন সংস্কৃতি ও আদি বাংলা শব্দমালাকে বাতিল করে আরবি ও ফরাসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটানো, মূল বাংলা বর্ণমালা বাতিল, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চার প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙ্গে দেয়া, উর্দু ভাষাকে রাষ্টভাষার নামে চাপিয়ে দিয়ে বাংলাভাষার সামাজিক ভিত্তির উপর আঘাত প্রভৃতি ছিল পাকিসতানী শাসকদের মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তারা একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে পাকিস্তানী শাসকরা অগ্রসর হন্ এর বিরূদ্ধে পূর্ব বাংলার প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে উঠতে থাকে। তার চুরান্ত বিস্ফোরন ঘটে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রূয়ারি । তৎকালীন পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগনের ভাষাগত অবস্থানটি লৰ্য করলে পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রের ¯^iƒc সহজেই অনুধাবন করা যাবে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জনগনের ভাষাগত অবস্থান ছিল নিম্নরূপঃভাষা = পশতু
, মোট জনসংখ্যা = ৩৫৮৯৬২৬, শতকরা হার = ৭.১।
ভাষা = বেলুচী, মোট জনসংখ্যা = ১০৭৫৯৯৯, শতকরা হার = ১.৪।
ভাষা = সিন্ধী, মোট জনসংখ্যা = ৪৩৫৯২৮৭, শতকরা হার = ৫.৮।
ভাষা = পাঞ্জাবি, মেট জনসংখ্যা = ২১৪৬৬৮১৫, শতকরা হার = ২৮.৪।
ভাষা = ইংরেজি , মোট জনসংখ্যা = ১৩৭৭৫৬৭, শতকরা হার = ১.৮।
ভাষা = উর্দু , মোট জনসংখ্যা = ৫৪১৯১৩১, শতকরা হার = ৭.২।
ভাষা = বাংলা, মোট জনসংখ্যা =৪১২৯১৮৮৯, শতকরা হার =৫৪.৬।
এই পরিসংখ্যানে প্রদত্ত তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সারা পাকিস্তানের ৫৪.৬ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী এবং মাত্র ৭.২ শতাংশ মানুষ উর্দু ভাষী। পাকিস্তানের সমগ্র অঞ্চলের মোট সাতটি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা অর্ধেকেরও বেশি মানুষের মাতৃভাষা এবং অন্য ছয়টি ভাষায় অর্ধেকেরও কম (শতকরা ৪৫ ভাগ) মানুষ কথা বলে সাহিত্য রচনা করে। অতএব যে কোন বিচারে যুক্তির মাপকাঠিতে এবং বাস্তব পরিস্থিতিতে একমাত্র বাংলাভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার অধিকার রাখতো। কিন্তু সমাজ এবং রাজনৈতিক মৌলিক বাস্তবতাকে A¯^xKvi করে শাসকমহল ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলাভাষা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির উপর নগ্নভাবে আক্রমন শুরূ করে। বর্তমান শতাব্দীর তিরিশের দশকের শেষ দিক থেকে ভারতবর্ষে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হয়। লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পূর্বে কংগ্রেস নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হিন্দীভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জোর প্রচেষ্টা ও তৎপরতা চলে এবং এতে মুসলমান সমপ্রদায়ের মাঝে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। হিন্দীকে রাস্ট্রভাষা করার পাল্টা দাবি হিসেবে ভারতের মুসলমান দের পক্ষ থেকে উর্দু ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দী ও উর্দু নিয়ে বিতর্ক থেকে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠে। দৈনিক আজাদ পত্রিকার ১৯৩৭ সালের ২৩ শে এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত বাংলা ভাষার সপক্ষে সম্পাদকীয় নিবন্ধের কিছু অংশ উদ্ধৃত করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবেঃ এই বিস্তৃত ভূখন্ডে (বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল) প্রায় ৭ কোটি ৩০ লক্ষ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। হিন্দী ভাষীর সংখ্যা এর চেয়ে বেশি নয়। ত্হা ছাড়া আসামী, উড়িয়া ও মৈথিলিও বাংলারই শাখা বলিয়া অত্যুক্তি হয় না। পূর্ববঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলার বিভিন্ন জেলায় উচ্চারণের কিছু প্রভেদ আছে বটে, কিন্তু লেখ্য বাঙ্গলার রূপ সর্বত্র একই। সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলা ভারতের সব প্রদেশীক সাহিত্যের মধ্যে শ্রষ্ট বাংলা ভাষার বিধিক ভাব প্রকাশোপযোগী শব্দের সংখ্যা বেশি। অতএব বাংলা সবদিক দিয়াই ভারতের রাস্ট্রভাষা হইবার দাবি করিতে পারে। রাষ্ট্রভাষার আসনের উপর বাংলা ভাষার দাবি m¤^‡Ü আর একটি কথাও বিশেষভাবে জোর দিয়া বলা যাইতে পারে। রাষ্ট্রভাষার নির্বাচন লইয়া হিন্দি-উর্দু সমর্থকদের মধ্যে আজ যে তুমুল সামপ্রদায়িক সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়া গিয়াছে, তাহার ফলে হয়তো হিন্দি-উর্দূর মধ্যে কোনটারই রাষ্ট্রভাষার আসন অধিকার করা সম্ভবপর হইবে না। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা হইলে এই সামপ্রদায়িক সংঘাত-সংঘর্ষের আশষ্কা বহ্থ পরিমান কমিয়া যাইতে পারে।