২৫ ডিসেম্বর, ২০১০

আমি নিজে অসন্তুষ্ট মানুষ নই, সন্তুষ্ট মানুষ, তৃপ্ত মানুষ -হাসান আজিজুল হক


আমাদের কথাসাহিত্যে জীবিত কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া লেখকের নাম হাসান আজিজুল হক। গত শতকের চলি্লশের দশকে জন্ম নেওয়া এই লেখকের হাত দিয়ে বেরিয়েছে অনেকগুলো সফল ছোটগল্প। লিখেছেন যে কয়েকটি উপন্যাস, তাতেও দৃশ্যমান তার শক্তির ঔজ্জ্বল্য। লিখেছেন এমনসব প্রবন্ধ, যা কারও ভাবনাকে পাল্টে দিতে পারে আমূল। এ কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিকের মুখোমুখি হয়েছিলেন সমকালের সহকারী সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ ও সাহিত্য সম্পাদক ফারুক আহমেদ। এই সাক্ষাৎকারপর্বে উঠে আসা নানা বিষয় থেকে উল্লেখযোগ্য অংশ কালের খেয়ার পাঠকদের জন্য পত্রস্থ হলো এ সংখ্যায়


ফারুক আহমেদ :আপনার কৈশোরের সঙ্গে যেসব স্মৃতি লেগে আছে, তা হলো_ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ, এ দেশে আসা ইত্যাদি_ এসব স্মৃতি আপনার লেখার মধ্যে বারবার এসেছে...
হাসান আজিজুল হক :আর আমাকে বলতে হবে না, যা বলার তার সমস্তটাই, অনুভূতি, কষ্ট একেবারে খুঁটিনাটি সবটাই লেখার মধ্যে আনার চেষ্টা করেছি। ওটা যদি করে থাকি_ এই যে এক বছর আগে বেরিয়েছে 'ফিরে যাই ফিরে আসি', আমি তো আত্মজীবনী বলি না, বলি আমার স্মৃতিকে অবলম্বন করে আমার সময়টাকে ধরার চেষ্টা করা। সময় তো ফাঁকা বস্তু নয়, সময় একদিক থেকে দেশ-মানুষ-কাল সবকিছু দিয়ে পূর্ণ। তার অর্থ হলো, পারলে কিছু সূত্র বের করা_ এগিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে যাওয়া, মানুষের বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকার ধরন, বেঁচে থাকার ভেতর দিয়ে জীবনের কোনো অর্থ বের করা যায় কি-না। আর যে সমাজটা চোখের সামনে রয়েছে, সে সমাজটাকে কতটুকু সুস্থ বলব, কতটুকু অসুস্থ বলব_ তার একটা চেহারা তুলে ধরা, এসবই তো লেখা। এটা তো সে অর্থে জীবনকথা বলেই লেখা, তার ছোট একটা অংশ যেটা প্রকাশিত হয়েছিল 'ভোর বেলাকার চোখে'। যার প্রথম অংশটা এ বছর বেরিয়েছে, সামনে দ্বিতীয় অংশটা বেরুবে। তার মানে ১০ বছর বয়স ধরেই আমার দুটি লেখা অর্থাৎ খুব ডিটেইল্ড লেখার চেষ্টা করছি আমি। লেখক হিসেবে অনেক ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয় সেটা আর নাইবা বললাম। তোমরাও কবিতা লেখ, গদ্য লেখ, তোমরাও জানো লেখা জিনিসটা আসলে কী! ফলে তুমি যদি এখন আমাকে আবার নতুন করে বলতে বল তা একেবারেই পুনরাবৃত্তি হবে।

ফা. আ :'আগুন পাখি'র যে চরিত্রটা সেটার ক্ষেত্রে কি আপনি নির্দিষ্টভাবে একজন, যা দেখা নাকি দেশ বিভাগের ফলে জমায়িত অসংখ্য অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এটি নির্মিত হয়েছে?
হা. আ. হ : ছোটগল্প সম্পর্কে একটি জায়গায় এ রকম লিখছি যে, ছোটগল্প বা উপন্যাস এর যেসব টার্ম আছে, এগুলো বলতে আমি প্রায় কিছুই বুঝতে পারি না। একটা লেখা আমি লিখছি সেক্ষেত্রে তার অভিধা বা নাম কী হবে সেটা মোটেও আমার ধর্তব্যের বিষয় নয়। আমি চেষ্টা করছি এই সময়টাকে ধরব। আরও কিছু কথা তার সঙ্গে যোগ করব। তাতে একটা চরিত্র তৈরি করতে হয়। সেটার সঙ্গে বাস্তব কোন চরিত্রটা নেওয়া হয়েছে তা অনেক সময় বলা যায়, অনেক সময় বলা যায় না। অনেক সময় নেওয়া হয়, অনেক সময় হয় না। অনেক সময় নিয়ে আপাদমস্তক বদলে ফেলা হয়, অনেক সময় যেমন নিয়েছি ঠিক তেমনিই থাকে। নানারকম ব্যাপার হয় আর কী। কিন্তু কখনোই সেটাকে বলা যায় না একেবারে স্থির এবং নির্দিষ্ট অমুক চরিত্রটা বা অমুক ব্যক্তিকে আমি চরিত্র হিসেবে নিয়েছি। তোমার এ প্রশ্নটার সম্মুখীন আমি বারবার হয়েছি। যেমন_ আপনার এখানে এই চরিত্রটির পেছনে কে আছে? তো, আমার বলতে কোনো সংকোচ নেই, আমি এমন একজনকে বেছে নেই। শুধু চলি্লশ দশক নয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধও যিনি দেখেছেন। শতাব্দীর গোড়াতেই যার জন্ম। তেমন একটা লোক পেলে আমার কী সুবিধা হবে? আমি চেয়েছি চরিত্রটি ওই স্তর থেকে নেমে আসুক। অর্থাৎ যেখানে পলিটিক্স হয়, যেখানে জনগণের ভাগ্য নির্ধারণ করে রাজনীতি, যেখানে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো কাজ করতে থাকে, এই জিনিসটা যে জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়, কাজ হয়, ভাঙাচোরা হয়, আমি এমন একজনকে বেছে নেব, যে এগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, যে এগুলোর ভেতরেও নেই। আমাদের গ্রামের খুব সাধারণ একজন মানুষকে আমি বেছে নেব, যে আজ থেকে একশ' বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাহলে এই একশ' বছর পিছিয়ে যেতে হলে যারা পাঠক তাদের সামনে ওই সময়টাকে ছবির মতো তুলে ধরতে হবে। গ্রামীণ জীবন অসম্ভব রকম নিস্তরঙ্গ। কিন্তু যে রকম বলা হয় গঠনমূলক আধুনিকায়ন হয়েছে; তা কিন্তু নয়। অনেক রকম বিকৃতিও হয়েছে। যেটি নতুনও নয় এবং পুরনোটা ভেঙে গেছে। আমি ধরতে চেয়েছিলাম অটুট রয়েছে এমন একটি বাংলাদেশের ছবি। ফলে একটি কর্নার বেছে নিলাম। সবচেয়ে সুবিধা হবে আমি যেখানে জন্মেছি। আর তার চেয়েও অন্তরঙ্গ হবে যার বুকে-কোলে আমি মানুষ হয়েছি। তাকেই সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছি। তাহলে আমার মাকেই আমি অবলম্বন করি না কেন? অন্য যে কোনো নারীকে করতে পারতাম। কিন্তু আমার কোথাও বলার দরকার নেই যে, এটা আমার মা। কোথাও বলার দরকার নেই মা অবিকল যা দেখেছেন, তার থেকে কিছু যোগ-বিয়োগ করা হয়নি। নানা রকম ব্যাপার লেখার সময় চলে আসে। ওই দিক থেকে লেখকরা সবচেয়ে বড় মিথ্যুক। এদের মতো মিথ্যাবাদী আর কেউ নেই। এরা প্রতিটি সত্যকেই মিথ্যা করে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত যে বড় মিথ্যাটা তৈরি করে সেটা দিয়েই একটি সত্যি তৈরি হয়। তাদের চেষ্টাটা সেখানটাতেই।
ইতিহাসের বিশাল বিশাল তরঙ্গের রেশ যেখানে কোনোরকম হালকাভাবে পেঁৗছেছে। সামান্য ঢেউ তুলেছে, সেই জায়গাতে সাধারণের সাধারণ যে মানুষটা তার প্রতিক্রিয়া থেকে যদি এই পুরো জিনিসটা দেখতে পাই, তার ভাষা থেকে, তার চিন্তার স্তর থেকে, তার অনুভব ভালোবাসা, ঘৃণা এবং কষ্টের যে বৃত্ত সেটাকে অতিক্রম করার চেষ্টা না করে, কোনোকিছু তার ওপর আরোপ না করে। এ কারণেই পুরো উপন্যাসটি একেবারে মুখের ভাষায় রচনা করার চেষ্টা করেছি। সেদিক থেকে তুমি আমাকে বলতে পার সবচেয়ে আধুনিক। কেননা আমার কোনো কিছু গ্রহণে কোনো কার্পণ্য নেই। আমি কখনওই এ ব্যাপারে কোনো সীমারেখা টেনে দেই না। কিন্তু যখনই কেউ বলবে, ভাষা এ রকম, ভাষা ওইরকম, মান ভাষা নেই, এসব কথা অপ্রয়োজনীয় এবং বৃথা শক্তিক্ষয়। আমার একটা খুব অন্যরকম ধারণা আছে, তা হলো অসাধারণ বলে কিছু নেই।
অসাধারণ হচ্ছে সব সাধারণকে ছেঁকে নিয়ে যে সাধারণ, ওই সাধারণটাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি অসাধারণ। ফলে আমি মনে করলাম যে, দেশভাগ হয়েছে তাহলে আমাকে যেতে হবে তাদের কাছে, যারা এই দেশভাগটা কল্পনা দিয়ে অনুভব করছেন না, যাদের এই দেশপ্রেমটা একটা বানিয়ে তোলা, কবিতা পড়া, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ দাশ পড়া নয়; যার দেশপ্রেমটা দেশের প্রতি ভালোবাসা, ঘৃণা, বিরাগ, অনুরাগ সব মিলিয়েই আছে। সেটা হচ্ছে ওই সাধারণ মানুষ। এটা আমার এক ধরনের বিশ্বাস যে, ওখানে গেলে খাঁটি জিনিস পাওয়া যাবে। এ জন্যই আমি ঐ চরিত্রটি বেছে নিলাম, যে গত শতাব্দীর গোড়াতে জন্ম নিয়েছে। যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর কিন্তু জীবনের গতি থেমে নেই। নানারকম তরঙ্গ উঠেছে। এগুলোর কোনোটা কানে আসছে কোনোটা আসছে না। রেডিও-ও তখন নেই, কাগজ_ গ্রামে একেবারেই আসে না। একজন পিয়ন আসে সপ্তাহে তিন দিন। তাছাড়া আর কোনোভাবেই বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না। 'বঙ্গবাসী' নামে একটি খুব পুরনো কাগজ বাই পোস্টে আমাদের বাড়িতে আসত। আর প্রত্যেকটি মানুষের জীবন এক থেকে দুই বা তিন মাইলের মধ্যে বাঁধা। আত্মীয়-স্বজন থেকে সবকিছু এটুকুর মধ্যেই, কিছুই দূরে নয়। পুরো এক ক্রোশ দূরে একটা ছোট লাইনের ট্রেন। একদিকে জেলা শহর অন্যদিকে মহকুমা শহর। আড়াই ঘণ্টা সময় লাগত ওই শহর থেকে এই শহরে আসতে। মাঝখানে ছোট ছোট কয়েকটি স্টেশন। ওখানেও পরিবর্তনের খবর পেঁৗছেছে। ওখানেও মা বলেন, সে কেমন মেয়ে, কাদের মেয়ে, দেশকে স্বাধীন করব বলে হাতে বন্দুক নিয়ে লড়তে যায়, ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে বিষ খেয়ে মরে যায়, এই মেয়েটি কে গো? প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দারকে সে অন্যভাবে চেনে না। এভাবেই চেনে। একি আমার মেয়ে? তখন তার এক ধরনের প্রত্যয় হয়। এ আমার মেয়েও হতে পারে, তোমার মেয়েও হতে পারে। ও এক কথায় সারা পৃথিবীর মেয়ে। এগুলো তার জীবনে আসছে। তাছাড়া একান্নবর্তী পরিবার কীভাবে ভাঙছে, সামন্ততান্ত্রিক পরিবারগুলো কেমন করে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে_ উপনিবেশের মধ্যে সামন্ততন্ত্র, সে আর কতদূরইবা যাবে। কতইবা বড় হবে। এই করতে করতে চারের দশকে চলে আসছে। চারের দশকে সব হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হচ্ছে, দুর্ভিক্ষ হচ্ছে, তারপর এক ধরনের সহিংস রাজনীতি হচ্ছে, হাতে ক্ষমতা পাচ্ছে বাঙালি, উগ্র হয়ে উঠছে তারা, শেষ পর্যন্ত দাঙ্গাও হচ্ছে। দাঙ্গার পর স্বাধীনতা হচ্ছে, স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে দেশটাও দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ওই যে মহিলা, ওই গ্রামের প্রায় নিরক্ষর ওই মহিলা। তার জীবন কথাটা বললেই তো আমার সব বলা হয়ে গেল। আমি সেটাই বারবার চেষ্টা করেছি।
ফা. আ : আপনার গল্পগুলো চিত্রকল্পময়, উপমায় ভরপুর, যেমন_ 'নামহীন গোত্রহীন' বা 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ'। আমি যদি বলি আপনার এসব গল্প ছোটগল্প নয়, এগুলো কবিতা, তাহলে আপনি কী বলবেন?
হা. আ. হ. : ওই কথাগুলো আবার বলব। এসব বিভাজন আমি বিশ্বাস করি না। আমার কাছে থাকে একটা লেখা। আমি একটা জিনিস লিখতে চাই। এটা অনেকটা আস্তে আস্তে দানা বাঁধার মতো। ওহ, এ কী কাণ্ড! চাষের জমির মধ্যে নোনাপানি ঢুকলে গায়ের জোরে চিংড়ি চাষ করে কৃষকদের বঞ্চিত করে কেউ কেউ কোটিপতি হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত যারা দুর্বল সেখানেই মানুষ বেশি আঘাত করে। কমিউনিটি হিসেবে হিন্দুরা দুর্বল। তাহলে চিংড়ি বাইরে চালান করে আমরা অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি। এটা ঠিক ব্যাপার নয় বা এটি একমাত্র ব্যাপার নয়। ফলে আমি একটা চিংড়ি ঘেরে গিয়ে রাত কাটালাম। এটা ঠিক লেখকগিরি করার জন্য বেড়ানো নয়। আমি এমনিতেই এ রকম বেড়াই। তো সেই ঘেরে বিছানাপত্র বলতে একটি করে মাদুর আছে। চারপাশে ভেজা জায়গার মধ্যে শুধু শোবার জায়গাটা তিন/চার ইঞ্চি উঁচু। কোদাল দিয়ে মাটি কেটে উঁচু করা। সেটার ওপর মাদুর ফেললেও তা ভেজা থাকে। ওখানে একটা সিন্দুক ছিল। ওখানের লোকগুলো সিন্দুকটা খুলে একেকজন একেকটা হাতিয়ার নিল। কেউ দা নিল, কেউ কুড়াল নিল, কেউ নিল বন্দুক। নিয়ে সবাই সশস্ত্র হয়ে একটা নৌকায় উঠল। নৌকার কাজ হলো একবার করে পুরো ঘের পরিভ্রমণ করা। টর্চ জ্বালিয়ে মাঝে মধ্যে আমাকে ওরা চিংড়ি দেখাল। এ রকম রাতে কয়েকবার তারা টহল দেয়। তারপর ওই চিংড়ি ধরার যে জাল ওটা দিয়ে চিংড়ি ধরল না, অন্য মাছ ধরল এবং পটকা মাছগুলো রান্না করল। খাওয়া-দাওয়ার পর দেখলাম একটা লোক বাইরে খোলা আকাশের নিচে একটা মাটির ঢিবির আড়ালে একটা বন্দুক নিয়ে উপুড় হয় শুয়ে পড়ল। সারারাত সে ওইভাবেই থাকবে। কোথাও আলো দেখলে সে গুলি করবে। কারণ এক চিংড়ি ঘেরের মালিক অন্য ঘের দখল করার চেষ্টা করে। এই যে তোমাদের কাছে যা বললাম, এটা লিখতে হলে আমার মনে হলো একটা সান্ধ্য ভাষা দরকার। একটা টানা জিনিস লেখা দরকার। চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে একটি মাত্র বাক্য ব্যবহার করে এটি লেখা যায় কি-না। এখন সেটা পড়তে গিয়ে যদি তোমার মনে হয় কবিতার মতো তাহলে আমার শুনে ভালো লাগে। কিন্তু এটা যে ওইভাবে পরিকল্পনা করে করা হয় তা নয়। আমার সব লেখার ক্ষেত্রেই তাই। একটা পুরো বাড়ি এক সঙ্গে তৈরি করার কথা তুমি বলতে পারবে? তোমাকে বলতে হবে বালি তৈরি করা, কাদা তৈরি করা, ইট তৈরি করা, কি-না আছে সেখানে। আর লেখাটাও তাই।
ফা. আ. : সেই ক্ষেত্রে আরেকটা কথা মনে হলো, 'শকুন' গল্পের শকুন যদি হিংস্র রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতীক হয়ে থাকে এবং ছেলেগুলো যদি সাধারণ জনগণ হয়...
হা. আ. হ. : হ্যাঁ, হতে পারে। নানাভাবে এটিকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। কিন্তু ওই কথাগুলো যারা গল্প পড়ছে, তাদের। এর একটাও লেখকের নয়। লেখা ছাড়া লেখকের আর কিছু দাবি নেই। এটাকে তোমরা বিনয় মনে করো না। আমি এ রকমই মনে করি।
মা. মো : আমার কিন্তু আরেকটা জিনিস মনে হয়। আপনার গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় একজন কবি আপনার ভেতরে আছে... যখন কলার গাছটা একবার বুক দেখায়, একবার পিঠ দেখায়_ এসব দৃশ্য যখন আমরা পার হই তখন মনে হয় কবিত্বটা আপনার ভেতরে একদম আগাগোড়া উপস্থিত।
ফা. আ : এটার সঙ্গে আমি একটু যোগ করব। জীবনানন্দ দাশের প্রতি আপনার এক ধরনের টান আছে। গল্পকার যখন একজন কবির চোখ দিয়ে বর্ণনা দেন তখন একজন কথাসাহিত্যিক কবিও এ সত্যই অনুভব হয়। এই দুই সত্তার মিলনেই ভালো একটা লেখা তৈরি হয়।
হা. আ. হ : আমরা বরং স্বীকার করি তাহলে এই জিনিসগুলোই কবিত্ব। কবিত্ব কাকে বলে? এক সময় এই বাংলাদেশে কিন্তু উপন্যাসকে কাব্য বলা হতো। এখন এটাকে কী নাম দেবে? সেই নামটা সঠিক, না বেঠিক তা আমি বলতে পারব না। উপলব্ধির এক অতলান্ত গভীরতা, চিন্তার এক ভীষণ সূক্ষ্মতা, তাহলে এগুলোই কি কবিতা? সঙ্গীতেও তো এসব জিনিস আছে। তাহলে সঙ্গীতও এক অর্থে কবিতা। নৃত্য যখন কল্পজাত হয়ে যায় সেটাও তাহলে কবিতা। সেই অর্থে গদ্য লেখক যারা, তারা সবাই-ই এক অর্থে কবি।
ফা. আ : হ্যাঁ স্যার। প্রকৃত গদ্য লেখক কবিও।
হা. আ. হ : জানি না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তোমরা কবি বলবে কি বলবে না।
মা. মো : হারু ঘোষ যখন দাঁড়িয়ে আছে এবং মারা গেছে আমরা বুঝতে পারলাম না।
হা. আ. হ : তাহলে দেখ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও কবি বলতে হয়। তাহলে কবিতার সংজ্ঞাটা কী রকমভাবে ছড়িয়ে যায়।
ফা. আ : কবিতার সংজ্ঞাটা আসলে কোথাও কবিতা বা গল্প হিসেবে নেই।
হা. আ. হ : কিংবা বলো এই বুড়ো গদ্য লেখকের গল্পকে ব্যাখ্যা করার জন্য ওই কবিত্ব শব্দটাকে ব্যবহার করা ছাড়া তোমাদের আর কোনো উপায় নেই।
ফা. আ :হ্যাঁ, এটা স্বীকার করতেই হবে। আর বাংলা সাহিত্যের শুরুটা যেহেতু কবিতা দিয়ে, তাই টানতে গেলে ওই কবিতার বিষয়টিই চলে আসে।
হা. আ. হ : সে কথাই বলছি। তুমি যদি ওটাকে টানো তাহলে রাবারের মতো বাড়তেই থাকবে। হোমারের 'ইলিয়ড' ওতো মহাকাব্য। সেও তো কবিতারই রূপ। আজই কথা হচ্ছিল সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। তিনিও একই কথা বলছিলেন। এই আলাদা আলাদা কক্ষ তৈরি করা বা ভাগ করে দেওয়া একদিক থেকে নিরর্থক। আর ওই জায়গা থেকে আধুনিকতা শব্দটি কি প্রায় অর্থহীন? কিন্তু অতি আধুনিক যারা তারা তো বলবে এগুলো আধুনিক নয়। এগুলো পশ্চাৎপদ। তারা বলবে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক কবিতা লিখছিলেন না। তাহলে তো এই বিশাল পঞ্চপাণ্ডব বাহিনী হতো না। এরা কোন অর্থে আলাদা? যে অর্থে আলাদা সেটাই তো আধুনিকতা। গল্পের বেলা তো তাহলে রবীন্দ্রনাথের 'ক্ষুধিত পাষাণ'। এটা কি অনাধুনিক গল্প? যদি মনে করি আধুনিকতা এগুলোই আর আধুনিকতাই আমাদের কাম্য আর যা আধুনিক নয়, তা একদিক থেকে বর্জিত, তাহলে তো খুব মুশকিল। এই প্রশ্নগুলো ভীষণ রকম গোলকধাঁধা তৈরি করে।
ফা. আ : সে ক্ষেত্রে যদি এগুলো আধুনিক না হয়, রবীন্দ্রনাথ যদি সেই সময়ে এগুলো না লেখেন তাহলে এক্ষেত্রে বলা যায় আধুনিকতাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়।
হা. আ. হ : আমার কথা শুনে যদি তোমরা এ রকম মনে কর তাহলে তো আমি অনেক আনন্দিত। শেষ বিচারে আসলে ওই অর্থে আধুনিকতা বা সমকালীনতা বলে কিছু নেই।
মা. মো : আপনার লেখাগুলোর মধ্যে একটা লেখাকে আমার খুব ব্যতিক্রম মনে হয়। সেটি হলো 'বৃত্তায়ন'। যেমন ধরা যাক, ওই গল্পগ্রন্থের 'পাবলিক সার্ভেন্ট' গল্পটি। এটি খুবই পলিটিক্যাল। সামরিক শাসনের সময়ে ওইটার তাৎপর্যও আলাদা। কিন্তু 'বৃত্তায়নে'র মতো গল্প যখন আপনি লিখে ফেললেন তখন আমি খুবই অবাক হয়েছি। আবার আপনার গল্পগুলো খুব সাধারণ মানুষের কথা হলেও তার ভেতরে আধুনিক মানুষের সংকট উপস্থিত। তাদের সম্পর্ক, যৌনতা, যৌনতার নানামুখী ডাইমেনশন ইত্যাদি উপস্থিত। তখন আর তারা অনাধুনিক থাকছে না। আধুনিক মানুষের নানামুখী মাত্রা যেন পেয়ে যাচ্ছে।
হা. আ. হ : তোমার কথাটা আমি বুঝেছি। কিন্তু একটা কথা বলি তোমাকে_ 'বৃত্তায়ন' কবে লেখা জানো? ঠিক পঞ্চাশ বছর আগেকার লেখা এটি। ১৯৬০ থেকে ২০১০_ পঞ্চাশ বছর। এটি হচ্ছে তাৎক্ষণিকতার সঙ্গে অমীমাংসিত একটি সন্ধানের দিকে যাওয়া। এটি আসলে শেষ হওয়ার নয়। তখন বোধহয় 'শকুন'টা বেরিয়েছে আর এক-দুটি গল্প হয়তো। ওই সময় 'পূর্বমেঘ' পত্রিকার সম্পাদক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বললেন, তুমি তো লিখছ মাঝেমধ্যে, তুমি শোপেন হাওয়ারের ওপর একটা লেখা দাও। আমি দিয়েছিলাম। সেটি 'পূর্বমেঘ' প্রথম সপ্তাহে ছাপা হয়। আরও একটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি বললেন, একটা বড় লেখা দাও। আমি তখন জ্যা পল সার্ত্র ভালো করে পড়ছি। 'এক্সিটেন্সিয়ালিজম অ্যান্ড হিউম্যানিয়ালিজম' নামে যে ছোট বইটা, আমি মনে করি যারা সার্ত্র পড়বে তাদের জন্য খুবই দরকারি, যদি তারা অল্প পড়ে ছোট করে জানতে চায়। আর তা না হলে 'বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস' পড়তে হবে। এটি আমি পড়েছি অনেক পরে। মানুষ কোনো না কোনোভাবে 'আমি টিকে আছি, আমিই আছি' এটিকে জানান দেওয়ার জন্য দেয়ালে পেরেক ঠুকে যেমন করে, আমরা লতা তুলি, তেমনি করেই কি ভায়োলেন্স দরকার? মানুষের হাতে মানুষের পৃথিবীটা যেভাবে ভাংচুর, নষ্ট, ধ্বংস হচ্ছে তাতে এই পুরো জেনারেশনটা এক অদ্ভুত বিকৃতির শিকার হয়েছে। একেবারে বিপদের মুখে পা দেওয়া, যাতে আমি ফিল করি, আমার এক্সিসটেন্টস, আই অ্যাম লিভিং। এই ঘোর অবশ্য পরে কেটে গেছে। কিন্তু যাদের মধ্যে এটি ছিল, তা আর যায়নি। এ ব্যাপারগুলো যদি অত্যন্ত যত্নসহকারে মিলিয়ে দেখা যায় তাহলে আমার মনে হয়, আধুনিকতার পুরো ব্যাপারটা বুঝতে বেশ সময় লাগবে। এর পাশাপাশি যদি নিজস্ব বিশ্বদৃষ্টি থাকে, তাহলে এগুলো বিশ্লেষণ এবং সমালোচনা করা সম্ভব। অর্থাৎ কোথাও একটি মেরুদণ্ড থাকতে হবে। প্রথমে প্রশ্ন করতে হবে, তারপর গ্রহণ। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই জায়গাটা একজন লেখক অর্জন করতে না পারবে ততক্ষণ সে সম্পূর্ণ লেখক হয়ে উঠবে না। ওটারই অধীনস্ত হলো আর যা কিছু তুমি কল্পনা করতে পার।
মা. মো. :দেশভাগের পর আমরা একটা স্রোত দেখলাম, যেটি ঢাকার দিকে প্রবাহিত। যেটা সোজা কলকাতা বা কলকাতার আশপাশ থেকে ঢাকায় চলে এসেছে। কিন্তু আপনার পরিবার এবং আপনি চলে গেলেন খুলনা। তারপর আপনি খুলনা, রাজশাহীতেই জীবনটা কাটিয়ে দিলেন। ঢাকার দিকে কেন এলেন না?
হা. আ. হ. : কতকটা আপতিক, কতকটা ইচ্ছাকৃত। যেমন ধর, খুলনা এসেছি আমরা '৬১ সালে। চাইলেই তো তখন বাড়ি পাওয়া যায় না। আর ঢাকাও তখন একটা ভিলেজ। যেসব আকর্ষণের কারণে তোমরা ঢাকা ঢাকা কর তার বিন্দুমাত্র তখন ঢাকায় ছিল না। ইট ওয়াজ এ ভেরি বিগ ভিলেজ। তখন মনে আছে, নবীন লেখক আমি, কত প্রত্যাশা নিয়ে দুরু দুরু বুকে সিকাণদার আবু জাফরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। অভয়নগরের ওখানে তিনি থাকতেন। একটা সাইকেল ছিল। সেই সাইকেলে চড়ে চলে গেলাম। প্রথম লেখা তিনি রিফিউজ করেছিলেন। বলেছিলেন, এই জাতীয় লেখা এখনও ছাপতে শুরু করিনি। একজন লেখকের ওপর খুব সমালোচনামূলক লেখা ছিল সেটি। আসার সময় আমার সাইকেলের চেনটা খুলে পড়ে গেল। সেটি সারানোর কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে সাইকেলটা গড়িয়ে গড়িয়ে অভয় দাস লেন থেকে আমি ফিরে এলাম ধানমণ্ডি। খুব নির্জন আর শান্ত ছিল সেই দুপুরবেলাটা। তাছাড়া অনেক সুবিধা-অসুবিধা আছে। চাইলেই তো ঢাকায় টিকে থাকা যায় না। তখন খুলনায় একটা বাড়ি পাওয়া গেল। কিছু জমি পাওয়া গেল ময়মনসিংহে। তার ফলে আমাদের সংসারটা একটু অগোছালো হয়ে গেল। আর আমার চাকরিটা হলো দৌলতপুরে। তখন বেশ আছি, ফুলতলায় আছি, চাকরি করছি। মনেও হয়নি ঢাকায় যাব, যেতে হবে। ঢাকার আকর্ষণ সেভাবে টের পাইনি। প্রায়ই ঢাকা এসেছি, নানা কারণে এসেছি। আস্তে আস্তে ষাটের দশকে যখন মোটামুটি লেখালেখি শুরু করি, ঢাকার আধুনিকতা যখন শুরু হয়ে গেল তখন এসব জিনিস আমাকে তেমনভাবে টানল না। এখন তোমরা যাদের ষাটের দশকের প্রবীণ রাগী লেখক বলে যাদের চেন, তাদের যেসব জিনিস টানল, আমাকে সেগুলো টানল না। আমার কেন জানি ভাষা নিয়ে, কবিতা নিয়ে নানানভাবে এক্সপেরিমেন্ট করা, নানান রকম সাহিত্যের আন্দোলন, হাংরি জেনারেশন, স্যাড জেনারেশন, পত্রিকার নাম হচ্ছে 'না'। কেন জানি আমার কাছে এগুলো কেবলই চটুল বলে মনে হতে থাকে। পরবর্তীকালে এখনও এ রকম অনেক কিছু সম্পর্কে মনে হয়, এগুলো আমার তেমন কোনো দরকার নেই।
সেই সময় আমারও রীতিমতো একটা নাম হয়ে গেল_ মফস্বলের লেখক। গরিব মানুষদের নিয়ে লেখেন-টেকেন, আধুনিক ভাষাটা তেমনভাবে রপ্ত করতে পারেননি। এসব কথা খুব চলত। তবে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল শওকত আলী। দেখা হতো প্রায়। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত আর দ্বিজেন শর্মা। আমি এলে দ্বিজেন শর্মার বাড়িতে উঠতাম। ড. দেবের বাড়িতে উঠতাম, হায়াতের বাড়িতে ওঠার সুযোগ কম হয়েছে। কারণ সে থাকত গেণ্ডারিয়ায়। চষে বেড়াতাম সব এলাকা। তারও আগে জ্যোতিপ্রকাশের বাড়িতে উঠতাম। পরবর্তীকালে আমাদের সঙ্গে এসে জুটলেন এখলাস উদ্দিন আহমেদ। মাঝে মধ্যে এসে ওই কয়েকটা দিন কাটানো আমার বেশ লাগত। এমন কোনো প্রতিজ্ঞা ছিল না, ঢাকায় আসব না। কিন্তু এমন কোনো আকর্ষণও মনে অনুভব করিনি, ঢাকায় আমাকে যেতেই হবে। তারপর ১৯৭১ সাল পার হলো এবং দ্রুত দেশের পটপরিবর্তন হলো। আজ যে ঢাকা একটা এসেনসিয়াল ব্যাপার হয়ে গেছে অনেকের কাছে, এটা শুরু হয়েছে সত্তরের দশকেরও পরে। অর্থাৎ আশি থেকে এই ক্রেজ চালু হয়েছে। বাড়ি ভাঙছে, হাইরাইজ বিল্ডিং উঠছে। আধুনিকতা প্রবেশ করছে এবং সেটা হলো মিথ্যা আধুনিকতা। কেননা যেসব দেশের অনুকরণে আমরা আধুনিক হতে চেয়েছি, সেসব দেশের মানুষ যে এ রকম করেন না তা কি আমরা ভুলে গিয়েছি, নাকি নেহাতই চকচকে জিনিসের প্রতি আমাদের আকর্ষণ_ তা আমি বলতে পারব না। ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষ এখনও এভাবে জীবনযাপন করে না। তারা যেমন জীবনযাপন করে সেটি আমাদের আজকালকার গ্রামের চেয়েও অনেক শান্ত। জ্যোতিপ্রকাশ তার যে বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে নিয়ে গেল, পাহাড়ের পাশ দিয়ে হাডসন নদীর ওপর দিয়ে যে বাড়িতে নিয়ে গেল সেখানে প্রচুর পাখি, প্রতিনিয়ত হরিণ দেখা যাচ্ছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে তারা। যেখানে হাডসন নদী মিলছে আরেকটা নদীর সঙ্গে সেই পয়েন্টটি দেখলাম এবং সেখান থেকে একটি বড় বিল্ডিং দেখলাম। যা ছিল একটা সমগ্র অ্যাটমিক ডিসকভারি, যেটা ভাঙতে পারলে আমেরিকা ভেঙে যেতে পারত। সব কিছুই আছে সেখানে। কিন্তু সে এক নির্জন জায়গা। আমি অনেক জায়গায় গিয়েছি। ওয়াশিংটন গিয়েছি, বোস্টন গিয়েছি, ম্যানহাটানে গিয়েছি। ম্যানহাটানে গেলেও হাইরাইজ দেখবে, চোখ কপালে উঠবে। তবে ওই রকম উদব্যস্ত, দুর্নীতি ছেয়ে যাওয়া নেই। সমস্তটাই সুব্যবস্থিত। আমাদের এখান থেকে সবটাই হারিয়ে গেল। এখানে একটাই আকর্ষণ, মানুষের আকর্ষণ। সেটি মিস যে করি না তা নয়। অনেককেই মিস করি। আর বর্তমান সময়ে এসে বলছি, মিসইবা করি কই। তারাইবা সময় দিতে পারে কই? তারপর বলি একাত্তরের পর রাজশাহী থেকে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক হয়ে এসেছিলেন ড. মযহারুল ইসলাম। তিনিই প্রথম। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কী কারণে যেন ড. খান সারওয়ার মুরশিদ, তিনি তখনকার রেজিস্ট্রারকে দিয়ে আমাকে একটি টেলিগ্রাম পাঠালেন রাজশাহীতে যাওয়ার জন্য। আমি যাওয়ার পর তিনি একটা অস্থায়ী নিয়োগপত্র দিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য। ফিরে আসার পর দেখি একটি চিঠি পড়ে আছে। চিঠিটি হলো 'অল অব দ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরস' হিসেবে বাংলা একাডেমীতে যোগদান করার জন্য আমন্ত্রণ। এই দুটি অফার এলো '৭৩ সালে। আমি দৃঢ়ভাবে শিক্ষকতাকেই বেছে নিলাম।
কেননা আমার মনে হয়েছিল লেখালেখির জন্য সবচেয়ে ভালো সময় পাওয়া যাবে অধ্যাপনা করলে। ওখানে মাথার ওপরে চোখরাঙানিটা নেই। স্বাধীনতা আছে। যখন পেছনের দিকে তাকাই তখন মনে হয় না যে, আমি ভুল করেছি।
মা. মো. : আমার মনে হয়, পঞ্চাশের দশকে ঢাকার যে বিদ্বৎসমাজ গড়ে উঠেছিল, তা মূলত দেশ বিভাগের ফলে এই অঞ্চলে আসা শিক্ষিত মানুষদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল। সেই পঞ্চাশের জেনারেশন হিসেবে আমরা যাদের ধরি, দেশভাগের ফলে মূলত তারা এসেছেন, অন্য কারণেও এসেছেন, কেউ কেউ আসেননি, তারা বেছে নেননি, ঢাকাকে পছন্দ করেননি। কিন্তু যারা এসেছেন তাদের মাধ্যমেই আজকের যে ঢাকার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তার একটা রূপ পেয়েছে। আপনি তাদের সঙ্গে পার্টিসিপেট করলেন না, দূর থেকে দেখলেন, এটাকে আপনি কী মনে করছেন?
হা. আ. হ. : এটা তুমি একটা চমৎকার প্রশ্ন করেছ। আমরা একদিক থেকে ভাগ্যবান। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর একটার পর একটা বিদ্বৎসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। প্রথম যুগের দিকে যদি তাকাও অনেক বড়মাপের মানুষ পাবে_ বুদ্ধদেব বসু, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, আরসি মজুমদার, মোহিতলাল মজুমদার_ তাদের পাবে। তারপর তারা দেশভাগের পর কেউ চলে গেছেন কলকাতা, কেউ অন্যত্র, অর্থাৎ এই নীড়টা ভেঙে গেছে। কিন্তু শূন্যস্থান যে একেবারে অপূর্ণ থাকল_ তা নয়। তুমি যাদের কথা বলছ অর্থাৎ যারা এলেন ওপার থেকে, তারা বেশিরভাগই কিন্তু এপারেরই মানুষ। যেমন এলেন আহসান হাবীব, তার বাড়ি বরিশাল; সরদার জয়েনউদ্দিনের বাড়ি পাবনা, রশীদ করিমের বাড়ি এ দেশেই। তারা সবাই কলকাতারই মানুষ, তাদের তৈরি হওয়াটা এবং কনট্রিবিউশন অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। সেই অর্থে এটাকে ঢাকাকেন্দ্রিক বা কলকাতাকেন্দ্রিক বলা যায় না। যেহেতু জয়েন্ট বেঙ্গল ছিল, এখানে যেমন কলকাতার বহু মুসলমান বিদ্বান ছিলেন, তেমনি তখনকার বহু হিন্দু কলকাতার বিদ্বৎসমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। আবার দেশ বিভাগের পর কলকাতা থেকে বহু মুসলমান এসে এখানে বিদ্বৎসমাজ গড়ে তুলেছেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তিনিও এসেছেন। আমার বয়স তখন একুশ কি বাইশ। এই বিদ্বৎসমাজ ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতেই আমার অনেকটা সময় লেগেছে। তাহলে এই বিদ্বৎসমাজ, তারা তো রাই কুড়িয়ে বেল। তাদের সঙ্গে তো ঢাকার কোনো সম্পর্ক নেই। এভাবে ঢাকায় অনেকে এসে জড়ো হয়েছেন আর অনেকে চলে গেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র চলে গেলেন, বুদ্ধদেব বসু, সত্যেন সেন চলে গেলেন, মোহিতলাল মজুমদার, তারাও চলে গেলেন। হাতেগোনা দু'চারজন মাত্র থেকে গেলেন। ফলে ওই সময়ের ব্যাপারগুলো আমি লক্ষ্য করেছি কিন্তু ওইখানে ঢোকা বা বের হওয়া বা তাদের কাছে আসা না আসা, এসব আকর্ষণ এগুলো হয়নি। তখন তো আমি নিজের ক্যারিয়ারই তৈরি করতে পারিনি। পঞ্চাশের দশকে তো আমি ছাত্র, আমি সিক্সটিক্স পাস করেছি।
মা. মো. : কিন্তু তখনকার ওই আন্দোলন-সংগ্রাম, এখানে নতুন নতুন চিন্তা হচ্ছে...
হা. আ. হ. :আমি যুক্ত ছিলাম আমার নিজস্ব ধরনে। আমি বাংলা বিভাজন এবং স্বাধীন হওয়ার ৮ বছর পর এসেছি। তার আগে আমি পূর্ব পাকিস্তান বা পাকিস্তান এ দুটো দেশের প্রতি ভালোমতো সচেতনই ছিলাম না। যেমন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ ওইভাবে সচেতন থাকে না। যেমন পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ বীরভূম-বাঁকুড়া সম্পর্কে কতটা সচেতন থাকে? তত বেশি সচেতন তো তারা থাকে না।
মা. মো. : এই যে আপনি দেখলেন, আপনার মতো করে একভাবে পার্টিসিপেট করলেন, কিন্তু আপনার নিজের কাজটা আপনি করে গেলেন; একভাবে আপনি অংশগ্রহণকারী, একভাবে আবার দর্শক; দূর থেকে দেখছেন, আসছেন-যাচ্ছেন। এখন আমরা যেটা স্বাভাবিকভাবে আশা করি, একটা সমাজ বা একটা রাষ্ট্র যখন গঠিত হয় বা বিকশিত হয়, তখন সব জায়গা থেকে সে নেবে। আসলে সে সেভাবে নেয়নি, কলকাতাও নেয়নি, ঢাকাও নেয়নি। সে চারদিক থেকে নেয়নি। অন্যদের থেকে নেয়নি। নিজে যা চিন্তা করেছে, অথর্ব-অজ্ঞান, যা নিজে গঠন করতে পেরেছে তা-ই করেছে। এখন আমার প্রশ্ন হলো, আপনি এই যে দীর্ঘ সময় ধরে দেখছেন, একটু দূর থেকে বা কাছ থেকে, এর মধ্যে বিদ্যমান যে সমস্যাগুলো বা সম্ভাবনাগুলো আপনি দেখলেন, সেগুলোকে কীভাবে চিহ্নিত করবেন?
হা. আ. হ. :মানুষ দেয় কখন আর নেয় কখন? যখন আমার থাকে না তখন আমি নিই আর যখন দেওয়ার মতো অবস্থা থাকে তখন দিই। এটা খুবই বেসিক জিনিস। কাজেই দেওয়া-নেওয়া ইচ্ছা এবং অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। আমি কলকাতার ভাষা, সাহিত্য, কথ্যভাষা, অর্থনীতি, লেখ্যভাষা_ কী কতদূর নেব, না নেব এটা আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। আমাকে প্রতিনিয়ত কর্মঠ থাকতে হচ্ছে। কর্মী থাকতে হচ্ছে, নিতেই হচ্ছে। তখন আমার যদি না থাকে তাহলে আমি হাত বাড়াব। আর যদি দেখি আমার যা আছে, অন্যের নেই, সে আমার কাছে হাত বাড়িয়েছে_ তাকে আমি দেব। তুমি যদি স্বাধীন বাংলাদেশের কথা বল, ওই হিসেবেই কিন্তু আজকের বাংলাদেশ চলছে। কে ঈর্ষা করে নিচ্ছে না এটা খুব বেসিক জিনিস নয়। আমাকে অনেকেই বলে, আমাদের বই ওরা কেনে না কেন, ওদের বই আমরা নেব কেন_ আমার কাছে এসব ব্যাপার খুবই ধাঁধা মনে হয়। ওরা আমাদের বই যদি না কেনে ওই কারণে আমরা ওদের বই কিনব না কেন? ওইটার জবাব তো এইটা নয়। আমাদের বই নেয় বা নেয় না, সেই কারণে ওদের বই কিনি বা কিনি না_ সেটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হতে পারে না। হতে পারে যে ওরা আমাদের বই তোয়াক্কা করে না বলে নেয় না। তোমাকে তোয়াক্কা না করে যদি তার চলে তাহলে তুমি কী করবে? কিছুই করতে পারবে না। একটা কাজ করতে পার যে, আমি এমন কিছু করব যা ওদের তোয়াক্কা না করে উপায় থাকবে না, হাত পাততেই হবে। অবস্থা কি এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়নি? ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির যেসব যোগাযোগ ছিল সেই যোগাযোগগুলো কি এখন অনেকটা বাড়েনি? পরিচয় কি অনেকটা বাড়েনি? এর আগে তো এটা মনে হওয়ার কথা, দুই-আড়াইশ' বছর ধরে যা কিছু নিলাম, সমস্তই পশ্চিম থেকে। চিন্তা, ভাবনা, কথা, প্রযুক্তি, আচার-আচরণ, পোশাক_ এমনকি প্রতিষ্ঠানগুলো যে আমরা করলাম, কোথায় থেকে করলাম? আইনগুলো কোথায় থেকে করলাম? এখনও আমরা বলিনি বাংলাদেশের জন্য আমি আমার মতো করে আইন তৈরি করব। সাহিত্য করতে গেলে এই নেওয়াটা হয়ে ওঠে ভেতরের অংশ। বাংলাদেশে আধুনিককালের র‌্যাশনালিজমের যে চর্চা, তার যে পরিভাষা, তা আমরা নিয়েছি পশ্চিম থেকে। আজকেও আমরা ভিক্ষুকের মতো, কাঙালের মতো হাত বাড়াচ্ছি। আমি বরং যেটার বিপক্ষে, ওদের যদি চিন্তার ইতিহাসটা দেখি, সেটা এত আলাদা, আমরা যে আগ্রহের সঙ্গে ফুকো দেরিদা পড়েছি, হেগেল, কান্ট, মার্কস পড়েছি_ তার শতভাগের একভাগ আগ্রহও কি 'উপনিষদ'-এর প্রতি দেখিয়েছি? কেন দেখাইনি, কেন উল্টেপাল্টে দেখলাম না তার মধ্যে রয়েছেটা কী? এখনও যদি তুমি বাংলা ভাষা খোঁজ, তৎসম শব্দ আর তৎসম থেকে তৈরি হওয়া শব্দ_ আমি ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ ব্যবহার করি। আরবি-ফারসি প্রায় ২০ পার্সেন্ট ব্যবহার করি। তাছাড়া পর্তুগিজ আছে, বহু ভাষা আছে। আমাদের খাঁটি বাংলাভাষার শব্দ খুবই কম। তাহলে ভাষাটা এইরকমভাবে তৈরি হয়েছে। এখানে কি গায়ের জোরে কাজ হবে? তুমি উচিত বানান যদি দীর্ঘ-ই-কার দিয়ে লেখ তাহলে কি আমি আধুনিকতার কারণে এটাকে ভুল বলব না? তাহলে কোনো জিনিস গভীরভাবে চিন্তা করলে দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
মা. মো. : আমাদের সাহিত্য, শিল্প, চিন্তা যেভাবে বেড়ে উঠল ঢাকায় বসে, '৪৭ বা '৭১-এর পর এই বিকাশের রূপরেখা বা ভুলত্রুটি আপনার পর্যবেক্ষণে কী রকম?
হা. আ. হ. :রাষ্ট্র ছাড়া একালে আর থাকার উপায় নেই। বিশ্বরাষ্ট্রও যদি বলে তাহলেও সেটা একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা। উইলিয়াম উইল 'ওয়ান ওয়ার্ল্ড' নামে বই লিখেছিলেন, তিনি অবশ্য ওয়ান ওয়ার্ল্ড বলতে আমেরিকাকে বুঝিয়েছিলেন। সবাই তার তাঁবেদার থাকবে। ওটা আর হবে না। এখনও হচ্ছে না। তাহলে তোমাকে রাষ্ট্র নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কেমন রাষ্ট্র তুমি গড়ে তুলবে। আমার মনে হয় এই জায়গাগুলোতে আমরা ঠিক করছি না। আমাদের অনেক ভুল আছে। তার হিসাব করে শেষ করা যাবে না। নাস্তিকেরও একটা নৈতিকতা আছে। তুমি নিজেই জান না তোমারও একটা হ্যাঁ এবং না আছে। আমার ধারণা খুব দ্রুত গোটা পৃথিবী ডি-হিউম্যানাইজড হয়ে যাচ্ছে। কার দাসত্ব স্বীকার করছি, এটা আমরা নিজেরাও বুঝতে পারছি না। প্রভু কে আর দাস কে? মানুষ, নাকি যন্ত্র প্রভু।
মা. মো. : আপনি আমাদের শিক্ষক। স্যার, আপনার কাছে শেষ প্রশ্ন হচ্ছে_ তাহলে আমাদের কী করতে হবে?
হা. আ. হ. :আমার মনে হয় ওইটুকুকেই খুঁজে বের করতে হবে যে, কী করব? তোমাকে একটা কাজ খুঁজে নিতে হবে, যে কাজটা মনে হবে এটা অন্ততপক্ষে আমার শক্তির মধ্যে, দক্ষতার মধ্যে আর বাঁচার সার্থকতার জন্য এই কাজটা আমার দরকার। অজস্র বাজে কাজের মধ্যে এটা যদি তুমি এক ঘণ্টাও করতে পার যে, দিস ইজ মাই ওয়ার্ক, তাহলে তুমি সুখী হতে পারবে। আমি নিজে অসন্তুষ্ট মানুষ নই, সন্তুষ্ট মানুষ, তৃপ্ত মানুষ।
সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেছেন : মেহেদি হাসান ও কাজী শফিকুর রহমান 
(এই সব কিছুই কালের খেয়ার, আরও জানতে লিংক টি দেওয়া হলো: http://www.samakal.com.bd/details.php?news=29&action=main&menu_type=tabloid&option=single&news_id=118213&pub_no=551&type)